পূর্ব ইউক্রেনের সোলেদরে কয়েক দিন ধরে চলা তুমুল যুদ্ধ নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টির মধ্যেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে সেখানকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করা হয়েছে। যুদ্ধ নিয়ে স্টাডি করা যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা ও যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ধারণা, ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপ সোলেদর শহরের ওপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ১২ জানুয়ারি রাশিয়ার বোমারু বিমান থেকে যেভাবে সেখানে উপর্যুপরি বোমা ফেলা হয়েছে, তাতে করে এই ধারণা জন্ম নিচ্ছে যে শহরটিতে এখন তুমুল লড়াই অব্যাহত আছে।
সুনির্দিষ্টভাবে সোলেদর যুদ্ধের ফলাফল এবং এটিকে ঘিরে যেসব ঘটনাপ্রবাহ ঘটতে চলেছে, তার ওপরে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করছে। তিনটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষা এ থেকে বেরিয়ে আসছে। প্রথমত, ছোট একটি ভূখণ্ডের বিজয় অর্জনের জন্যও অনেক সেনার প্রাণহানি যেমন ঘটতে পারে, আবার বিশাল সম্পদহানিও হতে পারে। রাশিয়া যদি শেষ পর্যন্ত শহরটির নিয়ন্ত্রণও নেয়, ধ্বংসস্তূপ ছাড়া সেখানে আর কিছু অবশেষ থাকবে না।
রাশিয়ার দিক থেকে সোলেদরের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার অর্থ হলো তারা এখন বাখমুতের থেকে পাথর ছোড়া দূরত্বে অবস্থান করছে। দোনেৎস্কর সর্বশেষ বড় শহর বাখমুত, যেটির দখল রাশিয়া এখন নিতে চায়। যদিও এখন পর্যন্ত ইউক্রেন দাবি করে যাচ্ছে সোলেদরের নিয়ন্ত্রণ শক্তভাবেই তাদের হাতে রয়েছে। এখন রাশিয়া যদি সোলেদরের ওপর সত্যি সত্যি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে পড়বে। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওই অঞ্চল থেকে ইউক্রেনের কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করতে হবে।
এ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, রাশিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত কমে আসছে। আবার একইসঙ্গে দনবাস অঞ্চলে স্থলযুদ্ধের তীব্রতা তারা বাড়িয়েছে। এর অর্থ হলো রাশিয়া এখন স্থলযুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করছে। এর মধ্য দিয়েই রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের নতুন নতুন ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্তে নেওয়ার আশা করছে। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে এ বদলের ঘটনা বলে দিচ্ছে, দনবাস অঞ্চলে রাশিয়া আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। অক্টোবর মাসে খেরসনে বিপর্যয়ের পর সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ করে খুব সফলতার সঙ্গে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন পুতিন।
দ্বিতীয়ত, সোলেদর যুদ্ধের ঘটনাবলি থেকে এটা স্পষ্ট যে দুই পক্ষই একটা চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করছে এবং কোনো ধরনের মীমাংসামূলক বন্দোবস্তে যেতে তারা অনাগ্রহী। রাশিয়ার প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে গেলে, সোলেদর কিংবা দোনেৎস্ক অঞ্চলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাহিনীর মধ্যে যে তুমুল যুদ্ধ চলছে, তাতে করে তাদের অনেক সেনা ও গোলাবারুদ ক্ষয় হচ্ছে। এ ক্ষয়ক্ষতি ক্রেমলিনের জন্য তখনই অর্থবহ হবে, যদি তারা ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে।
এ ছাড়া যুদ্ধ যত তীব্র হচ্ছে, রাশিয়ার রাজনৈতিক উপদলগুলোর মধ্যে ততই বিরোধ বাড়ছে। সোলেদরে চলমান হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ওয়াগনার গ্রুপের ইয়েভগেনি প্রিগোসিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি। প্রিগোসিন এ কাজে জড়িত হওয়ার পেছনে সেখানকার লবণ ও জিপসাম খনির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার উদ্দেশ্য রয়েছে। এ ছাড়া প্রিগোসিন তাঁর এ সাফল্যকে পুতিনের ঘিরে থাকা পরিমণ্ডলে প্রভাব বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে চাইবেন। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর শীর্ষ নিয়ন্ত্রক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর রয়েছে।
কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সোলেদর যুদ্ধে ইয়েভগেনি প্রিগোসিন জিতলেও রাজনৈতিক লড়াইয়ে তিনি হেরে বসেছেন। কেননা, তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র সের্গেই সুরোভিকিনকে সরিয়ে ভ্যালেরি গেরাসিমভকে ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হয়েছে। ইউক্রেনের বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস পরিকল্পনার মূল স্থপতি ছিলেন সুরোভিকিন। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মূল স্থপতি ছিলেন গেরাসিমভ। এ কারণেই তাঁর নিয়োগ থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে পুতিন এখনো তাঁর যুদ্ধের চরমপন্থী লক্ষ্য এখনো ত্যাগ করেননি। ফলে এ যুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার আশঙ্কা এখন তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউক্রেন সফরে গিয়ে সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বেলারুশ থেকে রাশিয়ান বাহিনী আগ্রাসন শুরু করতে পারে।
মস্কো ও মিনস্কের মধ্য সাম্প্রতিক কালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অনেক গুণ বেড়েছে। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যৌথ সামরিক মহড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। এর ফলে ইউক্রেন বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া সুরোভিকিনকে সরিয়ে গেরাসিমোভকে বসানো হলো এমন এক সময়ে, যখন ইউক্রেনে একের পর এক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করার পরও দেশটির প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। এ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, রাশিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত কমে আসছে। আবার একইসঙ্গে দনবাস অঞ্চলে স্থলযুদ্ধের তীব্রতা তারা বাড়িয়েছে। এর অর্থ হলো রাশিয়া এখন স্থলযুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করছে। এর মধ্য দিয়েই রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের নতুন নতুন ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্তে নেওয়ার আশা করছে। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে এ বদলের ঘটনা বলে দিচ্ছে, দনবাস অঞ্চলে রাশিয়া আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। অক্টোবর মাসে খেরসনে বিপর্যয়ের পর সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ করে খুব সফলতার সঙ্গে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন পুতিন।
তৃতীয় শিক্ষা হলো, দীর্ঘ মেয়াদে ইউক্রেনের জন্য আরও বেশি পশ্চিমা সহায়তা প্রয়োজন হবে। ইউক্রেনকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও যুদ্ধের যানবাহন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এর যেকোনোটা ইউক্রেনের কাছে পৌঁছানো মানে পশ্চিমা বিশ্ব যে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বিষয়ে শক্ত করে কিয়েভের পাশে আছে, তার প্রমাণ হয়। কিন্তু জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পোল্যান্ড এত ধীরগতিতে এগোচ্ছে যে চলমান সোলেদর যুদ্ধে তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।
স্টেফান উলফ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত