সব অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোনে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহার করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিজয় ‘এপিকে’ (কার্যত মোবাইল অ্যাপ) ছাড়া কোনো ধরনের স্মার্টফোন দেশে বাজারজাত করতে দেওয়া হবে না বলে নির্দেশনায় জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, বিটিআরসি যে মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা, সে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিজয় বাংলা কি–বোর্ড ও সফটওয়্যারের আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই বাধ্যবাধতায় ব্যবহারকারীদের কী সুবিধা হবে সেই প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘ব্যবহারকারীর দিক থেকে সে প্রথমত বিনা মূল্যে একটি সফটওয়্যার পাচ্ছে, বাংলা লিখতে পারবে। এর বেশি আর কী সুবিধা এখান থেকে পাওয়ার আছে? আমরা বলেছি, উৎপাদনকারী বা আমদানিকারক যেন সফটওয়্যারটা দিয়ে দেয়, যাতে ব্যবহারকারীর হাতের কাছে একটা বাংলা লেখার সফটওয়্যার থাকে এবং সেটা সে বিনা মূল্যে পায়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, তার কাছে বাংলা লেখার সফটওয়্যার বিনা মূল্যে দেওয়া, সরকার সেটাই করছে। কেউ যেন বলতে না পারেন যে আমি বাংলা লেখার কিছু পাইনি।’ (বিডিনিউজ ২৪, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩)
‘আমি বাংলা লেখার কিছু পাইনি’—এ প্রশ্ন কি ল্যাপটপ, পিসির ক্ষেত্রেও করা যায় না? সেখানেও কি বাজারজাতকরণ করার আগে বিজয় ইনস্টল থাকার কথা বলা যায় না? মুঠোফোনের কথায়ও যদি আসি। শুধু অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরাই এই প্রশ্ন করবেন? আইফোন ব্যবহারকারীরা করবেন না? আইফোনের জন্য কি বিজয়ের কি-বোর্ড আছে? শুধু কি-বোর্ড কেন, তথ্য-উপাত্ত খোঁজার জন্য বাংলায় সার্চ ইঞ্জিনও কি দিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়?
বাংলা লেখার সফটওয়্যার বিনা মূল্যে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখানে প্রশ্নটা ফ্রি কিংবা অতিমূল্যের নয়, এখানে প্রশ্নটা হলো যৌক্তিকতার। বর্তমান বাস্তবতায় ‘ফ্রি’ বলে কিছু নেই। আপাতদৃষ্টে ফেসবুকও ফ্রি। তার মানে কি তারা আয় করছে না? আবার, বিজ্ঞাপনই এই সব প্রতিষ্ঠানের একমাত্র আয়ের উৎস নয়। বলা হয়ে থাকে যে, ‘ইফ ইউ আর নট পেয়িং ফর দ্য প্রোডাক্ট, ইউ আর দ্য প্রোডাক্ট’ অর্থ্যাৎ, ‘আপনি যদি পণ্যের (সেবা) জন্য অর্থ প্রদান না করে থাকেন, তাহলে আপনি নিজেই পণ্য।’ অপর দিকে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়েও, মুঠোফোন আমদানিকারক বা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি বিড়ম্বনার পাশাপশি বাড়তি ব্যয়ও মেটাতে হবে। দিন শেষে, সেই ব্যয় ব্যবহারকারীকেই বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিজয় ছাড়া আরও কি-বোর্ড আছে। সেগুলোর কয়েকটি বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকের মতে, তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহারবান্ধব। এটি নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে যে, অন্যান্য কি-বোর্ড উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন সমান সুযোগ পায়। যদি কোনো স্ট্যান্ডার্ড বা স্বীকৃতির (যেমন বিএসটিআই) পূর্বশর্ত থাকে, তাদের সে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যেন কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয়, সেটিও আন্তরিকতার সঙ্গে দেখতে হবে।
কি-বোর্ড–জাতীয় সফটওয়্যার বা অ্যাপের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো, এর নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট দিকগুলো। এই কি-বোর্ড দিয়ে মুঠোফোনে কখন কী টাইপ করা হচ্ছে, তার সবকিছুই রেকর্ড করে রাখা সম্ভব। তা সে পাসওয়ার্ড হোক, বন্ধুকে পাঠানো খুদে বার্তা হোক কিংবা আর্থিক লেনদেনের তথ্যই হোক। ‘কি-লগার’ নামক একধরনের ম্যালওয়ার এই পদ্ধতিতেই ব্যবহারকারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বিজয় কি-বোর্ড কি উন্মুক্ত (ওপেন সোর্স) সফটওয়্যার? তা না হলে, সেটি কীভাবে কাজ করে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সরাসরি কোনো উপায় নেই।
এবার আসা যাক, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রসঙ্গে। আমরা যখন মুঠোফোনে অ্যাপ ইনস্টল করতে যাই, আমাদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমতি চাওয়া হয়। যেমন, ফটো গ্যালারিতে প্রবেশ করার অনুমতি, আমার জিপিএস অবস্থান জানার অনুমতি, কনটাক্ট লিস্ট দেখতে পারার অনুমতি ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে, কোনো অ্যাপ যদি তার এখতিয়ারবহির্ভূত কিছুর অনুমতি চায়, তাহলে সেই অ্যাপের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। একটি ক্যালকুলেটর অ্যাপ যদি কন্ট্যাক্ট লিস্ট পড়তে চায় অথবা জিপিএস অবস্থান জানতে চায়, সেটির যৌক্তিকতা যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে। দরকার হলে, সেই অ্যাপ ইনস্টল করা থেকে বিরতও থাকতে হতে পারে। কিন্তু, কোনো অ্যাপ বা এপিকে ইনস্টল করা যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে সেই অ্যাপ যা যা অনুমতি চায়, ব্যবহারকারী সে অনুমতি দিতে বাধ্য। অর্থাৎ, সেটি ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে বিজয় ছাড়া আরও কি-বোর্ড আছে। সেগুলোর কয়েকটি বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকের মতে, তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহারবান্ধব। এটি নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে যে, অন্যান্য কি-বোর্ড উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন সমান সুযোগ পায়। যদি কোনো স্ট্যান্ডার্ড বা স্বীকৃতির (যেমন বিএসটিআই) পূর্বশর্ত থাকে, তাদের সে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যেন কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয়, সেটিও আন্তরিকতার সঙ্গে দেখতে হবে।
বাংলার ডিজিটালাইজেশন, বিশেষ করে বাংলা কি-বোর্ড উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে, বিজয় কি-বোর্ড অন্যতম এক অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। এটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। বাংলা কি-বোর্ডের প্রাথমিক পর্যায়ের কঠিন ধাপগুলোয় বিজয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলা প্রসারে এই কি-বোর্ড ফ্রি দেওয়া, এর প্রচারণা চালানো, মুঠোফোনগুলোয় সেটি রাখতে উৎসাহিত করায় খুব বড় ধরনের সমস্যা আছে বলে মনে হয় না; কিন্তু সেটা যখন ‘বাধ্যবাধকতা’ দেওয়ার পর্যায়ে চলে যায়, তখন ডিজিটাল বিশ্বের নাগরিক হিসেবে, একজন ব্যবহারকারী হিসেবে, আমাদের বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বিটিআরসির এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: bmmainul@du.ac.bd