বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ইনস্টিটিউশনাল বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রচলনের আলোচনা আবার শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, কোভিড-১৯-এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে এ–সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির একটি খসড়া প্রক্রিয়াধীন ছিল। তাই জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস বলতে বোঝায় সাধারণত হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে প্র্যাকটিসের সুযোগ তৈরি করা।
বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসক নির্ধারিত কর্মঘণ্টার (সকাল ৮টা-বেলা ২–৩০) পর ব্যক্তিগত চেম্বার বা বেসরকারি হাসপাতাল/ ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন। এ ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর সরকারি হাসপাতালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিধান চালু করা হলে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
তা ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর দৌরাত্ম্য কমবে। কেননা, বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কনসালটেশন ফি এবং ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় অত্যধিক। অধিকন্তু সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মূল্য হ্রাস পেতে পারে এবং গুণগত মান উন্নত হতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালসমূহ পূর্ণকালীন চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ পাবে। এসব উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অর্জনের লক্ষ্যে ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালুর বিধান প্রণয়ন করা উচিত বলে একটি মত প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে ইনস্টিটিশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু আছে।
প্রথমে জানা যাক ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে কোন বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বহির্বিভাগ চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মূলত ওষুধ ও রোগনির্ণয় পরীক্ষার ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে রোগীকে বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ওষুধ প্রদানের সুযোগ নেই। তাই ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় হ্রাসে রোগনির্ণয় পরীক্ষার ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয় পরীক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
জেলা পর্যায়ে জেলা হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১০০ থেকে ২৫০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেসব জেলা বা সদর হাসপাতালে একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পর্যাপ্ত সহায়ক জনবল এবং ডায়াগনস্টিক টেস্টের সম্পূর্ণ সুবিধা আছে, সেসব জেলা হাসপাতালে এই প্র্যাকটিস চালুর সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০-২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালগুলো কিছুটা এগিয়ে রয়েছে।
ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ধরন কী রকম হওয়া উচিত? বাংলাদেশের কিছু চিকিৎসকের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অবস্থা ভালো থাকলেও অধিকাংশ চিকিৎসক এর ব্যতিক্রম। তাই অনেকে হয়তো ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে অন্তর্ভুক্তিতে আগ্রহী। কিন্তু তা বাধ্যতামূলককরণের কোনো সুযোগ নেই। এটা ঐচ্ছিক ভিত্তিতে চালু করতে হবে। যেসব সরকারি হাসপাতালে একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত সেসব হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করা যেতে পারে।
ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালুর প্রধান শর্তগুলো হলো পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও সহায়ক জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা; একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত থাকা এবং প্রয়োজনীয় ডায়াগনসিসের ব্যবস্থা থাকা। অন্য কথায়, ওয়ান–স্টপ সেন্টারের মতো সেবা প্রাপ্তির সুযোগ থাকা। এসব শর্ত বিবেচনাপূর্বক ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করা উচিত।
৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি ক্লিনিক্যাল গ্রুপের প্রতিটিতে একটি জুনিয়র কনসালট্যান্টের পদ থাকলেও অধিকাংশ পদ শূন্য রয়েছে। যেসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকে প্রেষণে অন্যত্র কর্মরত। অনেক চিকিৎসক নিয়মিত হাসপাতালে যান না। আবার সাধারণ চিকিৎসকদের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তা ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়া, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তারক্ষীসহ সহায়ক জনবলেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ল্যাব টেকনিশিয়ানসহ পর্যাপ্ত জনবল এবং ল্যাব সরাঞ্জামের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ডায়াগনস্টিক সেবার কার্যক্রমও বেশ নাজুক। এসব অবস্থার উন্নতি না হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর কোনো সুযোগ নেই।
জেলা পর্যায়ে জেলা হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১০০ থেকে ২৫০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেসব জেলা বা সদর হাসপাতালে একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পর্যাপ্ত সহায়ক জনবল এবং ডায়াগনস্টিক টেস্টের সম্পূর্ণ সুবিধা আছে, সেসব জেলা হাসপাতালে এই প্র্যাকটিস চালুর সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০-২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালগুলো কিছুটা এগিয়ে রয়েছে।
অধিকাংশ বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর সুযোগ আছে। তবে এ ক্ষেত্রেও ডায়াগনস্টিক টেস্টের সুবিধা বাড়াতে হবে।
এ ব্যবস্থা চালু হলে কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় চিকিৎসকদের উপস্থিতি কমতে পারে। ফলে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগীরা মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
তাই সরকার একটি বিকল্প উপায় ভাবতে পারে। সেটা হলো তুরস্কের মতো সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক চিকিৎসক নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা বা সার্জারি করা কিংবা সার্জারি–সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কাজ করার পর অতিরিক্ত রোগী দেখা বা সার্জারি করার জন্য রোগীপ্রতি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ প্রচলন করা। তবে এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ কতজন রোগী দেখতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এই অর্থের একটি অংশ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে প্রদান করা যেতে পারে।
অবশিষ্ট অর্থের একটি অংশ হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেবাসহ চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে এবং অন্য অংশ প্রশাসন, সহায়ক স্টাফসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টন করে দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগী এবং নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর সেবা নিতে আসা রোগীদের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফিতে একই মানের সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে, চিকিৎসকেরাও অধিক আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবাইকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা প্রদানে এ বিকল্প উপায়ই বেশি কার্যকর হতে পারে। তাই সরকারকে এ বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করা হলো।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক