কোটা সংস্কার: সরকারি নিয়োগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণেরা কেন পিছিয়ে?

চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা সরকারি নিয়োগে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি কর্মকর্তা পদে) কোটা সংস্কারের দাবি করেছেন। তাঁরা ২০১৮ সালে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁদের দাবি কোনো মতেই অযৌক্তিক নয়। সময়ের পরিবর্তন ও সমাজের বিবর্তনে নীতি বদলে নেওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। বদলে নেওয়া মানে সমকালের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তরুণদের দাবি যুক্তিযুক্ত কিনা বিবেচনায় না নিয়ে বিড়ম্বনা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁরা এই বিড়ম্বনার ভার সইতে না পেরে কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দিয়েছেন। যেন মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা। নীতিনির্ধারকেরা এতটুকুও চিন্তা করলেন না যে, কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের অনগ্রসর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে সরকারি নিয়োগের সুযোগ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না তো?

এতদিন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে (বিসিএস) ও ননক্যাডারে (দ্বিতীয় শ্রেণি) নিয়োগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ পাঁচ শতাংশ কোটা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু পাহাড় ও সমতলের ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা (আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে) মিলে প্রতিবছরেই ওই পাঁচ শতাংশ কোটার এক-তৃতীয়াংশের কম কোটা পূরণ করতে পেরেছিলেন। অনগ্রসরতার কারণে যারা প্রাপ্য দুই তৃতীয়াংশ সুযোগ আহরণ করতে পারছিলেন না, সেখানে প্রাপ্য কোটা বাতিল করে দেওয়ার অর্থ তাঁদের মূলধারা সুযোগ থেকে বের দেওয়ার শামিল। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও অন্তত ৪০টির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে এখনও পর্যন্ত বিসিএস কর্মকর্তা নেই। যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের চেতনাকেও ব্যাহত করে।

বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর কথা ধরা যাক। পার্বত্য বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। মারমাদের পরে তাঁদের স্থান। সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। এই জনগোষ্ঠী থেকে কোনো বিসিএস কর্মকর্তা নেই। এমনকি বিসিএসের প্রাথমিক পরীক্ষায়ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ম্রোদের মতো আরও ছয়টি জনগোষ্ঠীর একই অবস্থা। জনগোষ্ঠীগুলো হলো বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, খিয়াং ও ত্রিপুরা। যদিও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিসিএস কর্মকর্তা রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বসবাসরত চাক জনগোষ্ঠীর একজন চিকিৎসক রয়েছেন। প্রায় তিন হাজার জনসংখ্যার জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি একমাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। বম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এই পর্যন্ত কয়েকজন বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সোনার হরিণের ধারে-কাছেও যেতে পারেননি। সমতলের বিভিন্ন জেলায় ৩৯টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। মণিপুরী, গারো, হাজং, সাঁওতাল ও রাজবংশী ছাড়া সম্ভবত অন্য জনগোষ্ঠী থেকে ক্যাডার সার্ভিসে কেউ আছেন কিনা জানা নেই।

পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জনশুমারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনসংখ্যা পাহাড় ও সমতলে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করেন। কোটা পদ্ধতি বাতিল হওয়ার পর ২০১৮ সালে প্রথম কোটাবিহীন ৪০তম বিসিএসের নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাড়ে ১৬ লাখ মানুষের একজনও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন পাহাড় ও সমতলের কয়েক হাজার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত গিয়েছিলেন শতাধিক। সেখান থেকে মাত্র ১০ থেকে ১২ জন নন-ক্যাডার পদের জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় উঠে এসেছেন। এরপরে ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে (৪২তম বিসিএস শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডার) পরীক্ষার ফলাফল এখনও দেওয়া হয়নি। সেখানেও খুব একটা আশা-ভরসা নেই জানিয়েছেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা।

সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত যদি সকল শ্রেণির এবং বিশেষ করে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তাহলে সমতা অর্জন ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এমনিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের আত্মপরিচয় ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের প্রতি সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে বহুমাত্রিক প্রান্তিকতার বঞ্চনাবোধ রয়েছে। তার উপর যদি তাদের অগ্রসর শিক্ষিত শ্রেণিকে পদ্ধতিগতভাবে সরকারি নিয়োগের বাইরে রাখা হয়, সেটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিশ্চয় ইতিবাচক হবে না।

সরকারি নিয়োগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য পাঁচ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা ১৯৮৫ সালে প্রবর্তন হয়েছে। তখন থেকে অভিজ্ঞতা ভালো যাবে না। প্রতিবছর এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার বা দুই হাজার ২০০ জন বিসিএসে লোক নেওয়া হয়। দ্বিতীয় শ্রেণি ননক্যাডারে আরও বেশি। গড়ে দুই হাজার নিয়োগ ধরে নিলে পাঁচ শতাংশ কোটায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১০০ জন নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো বছরেই ৩০ জনের অধিক যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ বছরে এক চতুর্থাংশ, এক পঞ্চমাংশ কোটা পূরণ হয়েছে। কর্ম কমিশনের পরীক্ষা শাখার কর্মকর্তাদের মতে, কোটা হলেও নির্দিষ্ট মানদণ্ডের নিচে হলে নেওয়া যায় না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশের ফলাফল কোটারও নির্দিষ্ট মানদণ্ডের নিচে থাকে। কর্মকর্তাদের কথার নিঃসন্দেহে যৌক্তিকতা আছে। একেবারে কম মেধার প্রার্থীদের নিলে দাপ্তরিক কাজকর্ম চালানো কঠিন হবে। কিন্তু তাই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া কোটা পদ্ধতি বাতিল করা কি যৌক্তিক হয়েছে? সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত যদি সকল শ্রেণির এবং বিশেষ করে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তাহলে সমতা অর্জন ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এমনিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের আত্মপরিচয় ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের প্রতি সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে বহুমাত্রিক প্রান্তিকতার বঞ্চনাবোধ রয়েছে। তার উপর যদি তাদের অগ্রসর শিক্ষিত শ্রেণিকে পদ্ধতিগতভাবে সরকারি নিয়োগের বাইরে রাখা হয়, সেটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিশ্চয় ইতিবাচক হবে না। বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও প্রশাসন গঠনের দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে সরকারে নীতিনির্ধারকদের বিবেচনা করা জরুরি। বিবেচনা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কিন্তু এখনই।

সংবিধানে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ ও নারী-পুরুষ ভেদে বৈষম্যহীনতা এবং সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য উন্নয়ন ও সরকারি নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতার প্রয়োজনে বিশেষ বিধান প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় ভাগের ২৯ অনুচ্ছেদের ৩ (ক) ও ৩ (খ)-এ সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান প্রণয়নে রাষ্ট্র নিবৃত্ত করবে না। সংবিধানের সেই বৈষম্যহীন চেতনায় সমতা সৃষ্টির জন্য পাঁচ শতাংশ উপজাতীয় কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এটা অত্যন্ত যৌক্তিক যে, কাউকে পেছনে ও সুযোগের বাইরে রেখে দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সকল জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায়, উপসম্প্রদায়ের আনুপাতিক সমান প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকা জরুরি। না হলে সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে না। আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মানে বৈচিত্র্যের সহনশীলতা ও সহাবস্থান। এর ব্যতয় ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা। এমনিতে তাঁরা সংখ্যায়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ও আর্থসামাজিক অবস্থাসহ কয়েকটি স্তরে প্রান্তিক। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ অনন্তকাল ধরে কোটা চায় না। কিন্তু সমতা অর্জনের যোগ্য না হওয়া পর্যন্ত কোটা অবশ্যই জরুরি। না হলে তাঁদের বঞ্চিত করা হবে। পেছনে পড়া ও বঞ্চনাবোধে তাড়িত হওয়া জনগোষ্ঠী এক সময়ে বৃহত্তর সমাজে বহুমাত্রিকভাবে পিছুটান হয়ে উঠবে।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন পাঁচ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল দাবি জানিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। এতে তারা তিনটি দাবি তুলে ধরেছে। সেগুলো হলো পাঁচ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল ও নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন, ৪০তম বিসিএসের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীদের ফলাফল পুনর্বিবেচনা এবং প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিসহ সব শ্রেণির চাকরিতে পাঁচ শতাংশ কোটা নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রায় সময় বলেন, যাঁরা সবার পেছনে রয়েছে, উন্নয়ন সবার আগে তাদের কাছে যেতে হবে। তিনি ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর সংসদে বলেছেন, প্রয়োজনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের সরকারি নিয়োগে বিশেষ অগ্রাধিকারের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ তাঁর আশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। কারণ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের প্রতি তিনি সব সময় অত্যন্ত আন্তরিক।

  • বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি