কে বেশি চাপে-বিএনপি না আওয়ামী লীগ?

কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আগামী নির্বাচনের বিষয়ে বিদেশিদের কোনো চাপ অনুভব করছেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বিদেশের চাপ অনুভব করছি না। তবে বিবেকের চাপ অনুভব করছি।’

দলীয় অফিসে মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের হাস্যময় চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, তাঁরা খুব একটা চাপে নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তাঁরা বেশ চাপে আছেন, সেটা টের পাওয়া যায়। সরকারের কার্যক্রম নিয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক কিছু প্রকাশ হলেই নীতিনির্ধারকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। চিলে কান নিয়েছে বলে শোরগোল তোলেন।

বিরোধী দল বিএনপির চাপটা অন্য রকম। তারা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে। সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকায় বিএনপির সমাবেশগুলোয় লোকসমাগমও বেড়েছে। কিন্তু সেই ক্ষোভকে পুঁজি করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। আগে বিরোধী দলের আন্দোলনে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হাওয়া বুঝে অবস্থান নিতেন। এখন তাঁরা হাওয়াকে নিজেদের পক্ষে রাখতে মরিয়া। সম্প্রতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘুমন্ত মামলাগুলো জীবন্ত হওয়ার পেছনেও এই মনস্তত্ত্ব কাজ করছে।

এই মুহূর্তে বিএনপি চাপে আছে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। দলের নেতারা মনে করছেন, নিরীহ কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগকে কাবু করা যাবে না। কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। আবার কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হলে ধরপাকড় বাড়বে।

আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা ও মার্কিন ভিসা নীতির কারণে বিরোধী দলের ওপর সরকারের চাপ কিছুটা কমেছিল। তারা অনেকটা নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পেরেছিল। কিন্তু আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ক্ষমতাসীনেরা মনে করছে, বিরোধীদের মাঠ দখল করতে দেওয়া যাবে না। মাঠ দখলে রাখতে ছাত্রলীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে পাঁচ লাখ তরুণকে আনার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তরুণদের চেয়ে তরুণোত্তর বয়সীদের ভিড় বেশি ছিল।

তবে দেশের সাধারণ মানুষ আছে অন্য রকম চাপে। করোনার পর ডেঙ্গুর ভয়াবহ থাবা অনেক নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়া কিংবা রপ্তানির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারাও অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। চাল, ডাল, ডিম, মাংস, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে।

অনেকে বলেন, দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। একবার সিন্ডিকেট কোথাও হাত দিলে শতকোটি টাকা ক্রেতাদের পকেট থেকে হাওয়া হয়ে যায়। অথচ এই সিন্ডিকেট চোখে দেখা যায় না, হাতে ছোঁয়া যায় না। তারা কাজ করে যায় গোপনে গোপনে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই হলো ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ৫২ বছরেও নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সে ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে দেখা যায় পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন নিয়ে মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। মাঠে–ময়দানে, আকাশে–বাতাসে নির্বাচনী আওয়াজ। এই প্রেক্ষাপটে মুখে স্বীকার না করলেও আগামী নির্বাচন নিয়ে মহা পেরেশানিতে আছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। একজন মন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের ট্রেন নাকি কারও জন্য থেমে থাকবে না। কিন্তু সেই ট্রেনে যদি ভোটার নামের যাত্রীরাই না উঠতে পারেন, নির্বাচন করে কী লাভ?

নির্বাচন সামনে রেখে চাপে আছেন সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। ইতিমধ্যে মার্কিন ভিসা নীতি জানিয়ে দিয়েছে, যাঁরা নির্বাচনে অনিয়ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তাঁরাসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ভিসা পাবেন না।

যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের ওপর ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, সিয়েরা লিওনে ২০২৩ সালের জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনসহ সে দেশের গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের ওপর ভিসা নীতি আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সিয়েরা লিওন ও বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে সমর্থন ও এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ জুন সিয়েরা লিওনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ২১২(এ) (৩)(সি) সেকশনের আওতায় আজ আমি ভিসা নীতি ঘোষণা করছি।’

নিকারাগুয়া, কম্বোডিয়া ও সিয়েরা লিওনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি চালু হয়েছে নির্বাচনের পর। আর বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে। এতে বোঝা যায়, হোয়াইট হাউস বাংলাদেশের নির্বাচনকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা ও মার্কিন ভিসা নীতির কারণে বিরোধী দলের ওপর সরকারের চাপ কিছুটা কমেছিল। তারা অনেকটা নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পেরেছিল। কিন্তু আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ক্ষমতাসীনেরা মনে করছে, বিরোধীদের মাঠ দখল করতে দেওয়া যাবে না। মাঠ দখলে রাখতে ছাত্রলীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে পাঁচ লাখ তরুণকে আনার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তরুণদের চেয়ে তরুণোত্তর বয়সীদের ভিড় বেশি ছিল।

স্বাধীনতার পরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে তরুণদের বিচ্ছেদ ঘটে। সেই সময়ে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি হেরে যায়। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন ডাকসাইটে নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ছাত্রলীগের এত নেতা-কর্মীকে ভর্তি করেছি, কিন্তু নির্বাচনে জিততে পারেন না। ১৯৭২ সালে ডাকসুতে ছাত্রলীগের ভরাডুবি হয়। ১৯৭৩–এর ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়েও জিততে না পেরে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচনটি ভন্ডুল করে দেয়। সেই থেকে তরুণদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে বিচ্ছেদ ঘটে, ২০০৮ সালে সেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গত ১৪ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দখলদারির কারণে আবার তরুণদের সমর্থন হারায়।

নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের বড় চাপ মার্কিন ভিসা নীতি নয়, তরুণদের সমর্থন হারানো। যে ছাত্ররাজনীতি বুয়েটের আবরার ও নিরীহ দরজি বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যায় প্ররোচিত করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় টর্চার সেল ও গেস্টরুম সংস্কৃতি তৈরি করে, সেই ছাত্ররাজনীতি কীভাবে বৃহত্তর তরুণদের সমর্থন আশা করে?

লেখাটি শুরু করেছিলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ‘বিবেকের চাপ’ নিয়ে। তাঁরা যদি সত্যি সত্যি বিবেকের চাপ অনুভব করেন, তাহলে বিএনপি বা মার্কিন ভিসা নীতির দিকে তাকানোর আগে একবার ছাত্রলীগের দিকে তাকানো উচিত। সেনা শাসনের আমলে ওবায়দুল কাদের সাহেবেরা যখন বিরোধী দলের ছাত্ররাজনীতি করেছেন, তখন কি তাঁদের হল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে? যদি না হয়ে থাকেন, আজ গণতান্ত্রিক শাসনামলে কেন বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা হলে থাকতে পারছেন না?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

    ই–মেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com