মতামত

সিটি নির্বাচন ও সাধু তস্করের মহড়া

একদিকে চলছে সরকার দলীয় প্রার্থীর ব্যক্তিগত গাড়ির মহড়া, অন্যদিকে নির্বাচনে না থাকলেও চলছে বিএনপি নেতা–কর্মীর ওপর ধরপাকড়
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন ক্ষমতায় এসে সরকারের প্রথম কাজ ছিল আগের সরকারের আমলে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন। এরপর সেই কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করত। আবার সেই দল ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাদের বিপক্ষ দল মসনদে বসেও একই কাজ করত। ১৯৯১ সাল থেকে পালাক্রমে এ ধারা ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলে এসেছে।

কিন্তু ২০০৯ সালের পর মামলা প্রত্যাহারে নতুন করে কমিটি গঠনের প্রয়োজন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার আগের আমলে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলা এক এক করে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীদের মামলাগুলো যথারীতি চলছে। ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আছে। ফলে সেই সময়ে যাঁরা মামলা করেছিলেন, এখনো তাঁরাই মামলা করছেন। সেই সময়ে যাঁরা মামলার ভুক্তভোগী ছিলেন, এখনোও তাঁরাই ভুক্তভোগী। যখন আন্দোলন কিছুটা চাঙা হয়, মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। আন্দোলন স্তিমিত হলে মামলাও কমে যায়।

সম্প্রতি ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর মামলা-ধরপাকড় চলছে বলে অভিযোগ আছে। সহকর্মী সুমনকুমার দাস প্রথম আলোয় লিখেছেন, একের পর এক বিএনপি ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। গত চার দিনে মহানগরের অন্তত ১৭ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তল্লাশির নামে নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানির অভিযোগও পাওয়া গেছে। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ এ ‘ধরপাকড়’ শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতারা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ অবস্থায় বিএনপির মনোনয়নে টানা দুবার সিলেটে মেয়র নির্বাচিত হওয়া আরিফুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন কি না, তা স্পষ্ট করতে ২০ মে নগরে জনসভা ডেকেছেন। আরিফুলের জনসভা ডাকার পর থেকেই মূলত চাপে পড়েছে বিএনপি। (প্রথম আলো, ৬ মে ২০২৩)

আওয়ামী লীগের নেতারা বলবেন, বিরোধী দলে থাকতে তাঁদের বিরুদ্ধেও হাজার হাজার মামলা হয়েছে। অনেককে কারাগারে থাকতে হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজমিয়া কাহিনি সাজানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একাধিক স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর অর্থ যখন যে দল বিরোধী দলে থাকে, সেই দলের নেতা-কর্মীরা দুর্ধর্ষ অপরাধী হয়ে পড়েন। আর ক্ষমতাসীন দলে থাকলে সবাই শুদ্ধতম মানুষ হয়ে যান। ক্ষমতার এমনই মহিমা যে সাধুকে চোর এবং চোরকে সাধু করে ফেলে।

মঙ্গলবার গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সারা দেশে বিএনপিসহ বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের নামে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৪৩টির বেশি মামলা করা হয়েছে। আসামির সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮১ জনের বেশি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২ হাজার ৮৩০টির বেশি, যেগুলোর মধ্যে ঢাকাতেই দেড় হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে বিরোধীদের মাঠ থেকে সরাতে সরকার আগের খেলায় মেতে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুরু করেছিল, এবার তারা অনেক আগে থেকেই।

মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী মতের দলগুলোর এই সরকারের অধীন নির্বাচন না করা এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে দেশবাসী যখন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, ঠিক সে সময় সরকারের মন্ত্রী এবং শাসকগোষ্ঠীর নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যাচার ও অলীক কথা বলছেন।...বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে।

মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে গত ১০ বছরে ৯২টি মামলা দেওয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে যত মামলা, তাঁকে আপাতদৃষ্টে ভয়ংকর অপরাধী মনে করা স্বাভাবিক। তবে মির্জা ফখরুল একজন সজ্জন ও ভালো রাজনীতিক হিসেবে সমাজে পরিচিত। এমন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা দেওয়া অমানবিক।

ভয়েস অব আমেরিকার তথ্যানুযায়ী, (২৯ ডিসেম্বর ২০২১) পুলিশ, আদালত ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে—২০০৯ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার। বেশি মামলা হয়েছে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে। মামলা হয়েছে কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়েও। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৭টি। এর মধ্যে দুটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। উচ্চ আদালতে ১৬টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মূলত মামলা হয়েছে দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহসহ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে।

এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ১১টি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ৪, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৬, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৫৯, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৩, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৩, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ৬, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯ ও ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩৪টি।

সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫৭টি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৪টি, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে ৪, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬, আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে ৪, বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ২৭, আবদুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে ৬ ও মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ২৪টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১২৩, আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে ৩৭, মিজানুর রহমান মিনুর বিরুদ্ধে ৩৭, জয়নাল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে ২৩, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে ১৩, মজিবুর রহমান সারোয়ারের বিরুদ্ধে ৫৭, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১৩৪ ও খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে ১০৭টি, আসাদুল হাবিবের বিরুদ্ধে ৫৭, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফের বিরুদ্ধে ৪৭, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে ৮৬, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ১৫৩, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৫৩ ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলবেন, বিরোধী দলে থাকতে তাঁদের বিরুদ্ধেও হাজার হাজার মামলা হয়েছে। অনেককে কারাগারে থাকতে হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজমিয়া কাহিনি সাজানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একাধিক স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর অর্থ যখন যে দল বিরোধী দলে থাকে, সেই দলের নেতা-কর্মীরা দুর্ধর্ষ অপরাধী হয়ে পড়েন। আর ক্ষমতাসীন দলে থাকলে সবাই শুদ্ধতম মানুষ হয়ে যান। ক্ষমতার এমনই মহিমা যে সাধুকে চোর এবং চোরকে সাধু করে ফেলে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধু ও তস্করের এই মহড়া আমরা কত দিন দেখব?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com