মতামত

গণতন্ত্র, গুম, মানবাধিকার—সবই ভাঁওতাবাজি!

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডিকাব টকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দ্রুত উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ এখন অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছে।
ছবি: সংগৃহীত

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বছরের ২০ ডিসেম্বর বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে তারা বাংলাদেশকে পরামর্শ দেয়। এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ ও উপদেশকে স্বাগতই জানিয়েছেন।

১৫ জানুয়ারি ঢাকায় দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বৈঠকের পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যদি কোনো ধরনের কোনো প্রশ্ন থাকে, সেগুলো আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। আমরা পরামর্শ পেলে অবশ্যই গ্রহণ করি, আমরা তার নমুনাও দেখিয়েছি। আমাদের কোথাও যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, আমরা সেগুলো আমলে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করব।’
ওই সফরকালে ডোনাল্ড লু বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয়। পাশাপাশি দেশটি সবার রাজনীতি করার অধিকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সে সময় সরকারের একাধিক মন্ত্রী ডোনাল্ড লুকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

ডোনাল্ড লুর সফর ঘিরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিতে অনেকের নজর ছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে এটা মন্ত্রীদের কথাবার্তায়ও এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে পাশে রেখে মন্ত্রণালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড লু বলেছেন, ‘র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। আপনারা এ সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের দিকে তাকালে দেখবেন, র‍্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে অগ্রগতি হয়েছে, তা উঠে এসেছে, আমরাও সেটা দেখতে পেয়েছি। এটা অসাধারণ কাজ।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা যত খুশি পর্যবেক্ষক পাঠান, আমরা স্বাগত জানাব।’ আর দেশে এসে বলছেন, ‘বিদেশি পর্যবেক্ষক এল কি এল না, তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।’ কোনটা সত্য? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমস্যা হলো তিনি সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে আরেক কথা। মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে?

সে সময় সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহ্লাদিত হলেও সেসব প্রশ্ন নিয়ে এখন উষ্মা প্রকাশ করছেন। ৮ জুলাই ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডিকাব টকে তিনি বলেন, দ্রুত উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ এখন অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, গুম—এগুলো সব ভাঁওতাবাজি। বিভিন্ন দেশেই মানুষ হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি যে, কেউ কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।’

কারা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদেরই খুঁজে বের করতে বলেন। অর্থাৎ ভাশুরের নাম নেওয়া যাবে না। আবার কোনো দেশের নাম যে একেবারে নেননি, তা-ও নয়। তিনি তাঁর বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তরে বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টানেন।

নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপ প্রসঙ্গে আব্দুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোনো দেশে এ ধরনের সংলাপ হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে কোনো সংলাপ হয় না। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন না।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচনে বিএনপিকে আনার বিষয়ে তার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এখন বলছেন উল্টো কথা। তিনি ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য মন্ত্রী গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকারের বিষয়ে যেসব যুক্তি খাঁড়া করছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতারা ঠিক সেগুলোই বলতেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেন পদত্যাগ করেন না, আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের নির্বাচনের আগে কেন পদত্যাগ করতে হয়, সেটা মোমেন সাহেব আমেরিকায় থাকার কারণে না জানলেও বাংলাদেশের মানুষ ভালো করে জানেন।

আওয়ামী লীগ দাবি করে, তারাই বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির তৈরি করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই এতে সব দল, যারা ইচ্ছুক তারা নির্বাচনে অংশ নিক। তবে কোনো ‘সন্ত্রাসী দল’ নির্বাচনে অংশ না নিলে সমস্যা নেই।’ মন্ত্রী মহোদয় ‘সন্ত্রাসী দলটি’র নাম বললে জনগণ উপকৃত হতো। ‘সন্ত্রাসী’ দলের রাজনীতি করারই তো অধিকার থাকার কথা নয়। তারা নির্বাচন করবে কীভাবে?

আবদুল মোমেন আরও বলেছেন, ‘তারা বলে আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। অথচ আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না।’ বাংলাদেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এত মানুষ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য জীবন দেয়নি। বিদেশিদের এটা জানা উচিত।’
এটাই তো আসল প্রশ্ন। যেই দেশের মানুষ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এত রক্ত দিয়েছে, এত প্রাণ দিয়েছে, সেই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে পারে না, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা একবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আনে, আরেকবার সেটি বাতিল করে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি। আর ক্ষমতায় গেলে সেটি না-হক হয়ে যায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নিয়েও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কিছু সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তাঁদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় পড়তে যায় এবং তারা সেখানে বাড়ি কেনে। মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’

সত্যিই কি তা-ই? মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে যদি কোনো উদ্বেগই না থাকবে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঝারি পর্যায়ের নেতারা উষ্মা প্রকাশ করলেন কেন? দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো বলেই দিলেন, আমরা ভিসা নীতি ঘোষণা করতে পারি। তাঁর কথায় মনে হচ্ছে, ৫২ বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কোনো ভিসা নীতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির পর বাংলাদেশকেও একটি নীতি করতে হবে। শুরু থেকে প্রত্যেক দেশেরই ভিসা নীতি থাকে। সেই নীতির ভিত্তিতেই বিদেশিদের ভিসা দেওয়া হয়। একসময় বাংলাদেশের পাসপোর্টে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল ছাড়া কথাটি লেখা থাকত। এখন সেটি আর থাকে না। বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতিতে বিদেশিদের জন্য সে রকম কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা মেনে নিলে অন্য দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা হলে আমাদের দেশেও বিচারবহির্ভূত হত্যা হতে পারে। অন্য দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে বাংলাদেশেও সেটা ন্যায্যতা পায়। আমরা কি বিদেশের সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা ইত্যাদিতে প্রতিযোগিতায় নামব না আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেব? আমরা কি অন্য দেশের মন্দ কাজকে অনুসরণ করব না নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধান করব?

মন্ত্রী মহোদয় ক্ষমতায় থেকে যে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন করার কথা বলেন, তা-কি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে? বিদেশিদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কয়েক দিন আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘২০১৮ ও ২০১৪ এর নির্বাচন উদাহরণ হতে পারে না।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা যত খুশি পর্যবেক্ষক পাঠান, আমরা স্বাগত জানাব।’ আর দেশে এসে বলছেন, ‘বিদেশি পর্যবেক্ষক এল কি এল না, তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।’ কোনটা সত্য? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমস্যা হলো তিনি সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে আরেক কথা। মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

ই–মেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com