পূর্ব জেরুজালেমের আল–আকসা মসজিদের ভেতরে ঢুকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী নামাজরত ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের নির্বিচার পেটাচ্ছে—এমন একটি ভিডিও ফুটেজ ৫ এপ্রিল গণমাধ্যমে এসেছে। ইসলামের তৃতীয় সর্বোচ্চ পবিত্র স্থানে চালানো ওই বর্বর হামলায় সেদিন কমপক্ষে ১২ জন ফিলিস্তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনা জনক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ ধরনের হামলা হলে সহিংসতা বাড়বে, এমন হুঁশিয়ারি হিসেবে গাজা ও লেবানন থেকে ইসরায়েলে রকেট ছোড়া হয়েছে, তবে ইসরায়েল তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। বরং পরের দিন ইসরায়েলি বাহিনী আবার আল হারাম-আল-শরিফে (এই চত্বরেই আল–আকসা মসজিদ অবস্থিত) হামলা চালায়। গাজা ও লেবাননেও বিমান হামলা চালায়।
এখন পর্যন্ত এটি পরিষ্কার যে ফিলিস্তিনে আরও একটি উত্তেজনার উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যত যে চেষ্টা ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে, নতুন এই উত্তেজনা ও সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনিরা একেবারেই দায়ী নয়।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওয়াশিংটনের হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমানোর সদিচ্ছা ছিল; কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মরিয়া চেষ্টা ওয়াশিংটনের সেই সদিচ্ছার সহায়ক হবে না। বরং নেতানিয়াহু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য এমন আরও কিছু করতে পারেন, যা পূর্ব জেরুজালেমের বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে উত্তেজনা বাড়তির দিকে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধারা, বিশেষ করে জেনিন ও নাবলুস শহরে অধিকতর সক্রিয় ছিল এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলোতে সহিংস অভিযানও চালিয়ে আসছে। ২০২২ সালে ইসরায়েলি বাহিনী ৩০ জন শিশুসহ কমপক্ষে ১৭০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও প্রায় ৯ হাজার জনকে জখম করেছে। জাতিসংঘ এই বছরটিকে পশ্চিম তীরের জন্য ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক বছর বলে উল্লেখ করেছে।
অন্যদিকে হামাস পশ্চিম তীর, জেরুজালেম ও ইসরায়েলে বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ করার পরিকল্পনা করায় ইসরায়েল চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আল–আকসায় যাতে ইসরায়েলের বাহিনী ঢুকতে না পারে, সে জন্য বিপুলসংখ্যক মুসল্লি হামাস জড়ো করতে চায়। অনেকে এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে নেতানিয়াহুর সরকার হয়তো এই আগ্রাসী আক্রমণ দিয়ে আল–আকসায় ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, যেটি তারা হেবরন শহরের (আগের নাম আল খলিলি) ইব্রাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রে করেছিল।
এ বছর মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসে ইহুদিদের পাসওভার দিবস (পেচাস) পড়ে যাওয়ায় আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, সুতরাং এটি স্পষ্ট ছিল যে বছরের এই সময়টি সহিংসতার জন্য আরেকটি সম্ভাব্য ফ্ল্যাশ পয়েন্ট হবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে—এমন একটি বড় উত্তেজনা রোধ করার আশায়, পরিস্থিতি শান্ত করার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে দুটি আঞ্চলিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জর্ডানের বন্দর শহর আকাবায় ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, জর্ডান, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব পক্ষ ‘উত্তেজনা প্রশমনে ও ভবিষ্যতের সহিংসতা বন্ধে’ জোর দিয়েছে এবং পরবর্তী ছয় মাস ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কোনো অবৈধ বসতি স্থাপনার অনুমোদন দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
এরপর গত ১৯ মার্চ মিসরের শারম আল-শেখ শহরে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে জেরুজালেমের পবিত্র শহরের মর্যাদা ‘কথায় ও কাজে’ বজায় রাখার এবং বিশেষ করে রমজান মাসে সহিংস পরিস্থিতিতে না জড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার না কথায়, না কাজে জেরুজালেমের পবিত্র শহরের মর্যাদা বজায় রাখতে পারছে। কারণ নেতানিয়াহু এমন উগ্র ইহুদি ধর্মীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, যারা প্রকাশ্যে বলে থাকে, পবিত্র স্থাপনাগুলোকে জর্ডানের তত্ত্বাবধানে দেওয়ার বিষয়টিকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেওয়া একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল এবং সেই ‘ভুল’ ইসরায়েলকেই ‘শোধরাতে হবে’।
চরম উগ্র ইহুদিবাদী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন-গাভিরের আল হারাম-আল-শরিফে উসকানিমূলক প্রবেশ দিয়ে ২০২৩ সাল শুরু হয়েছে। তাঁর তত্ত্বাবধানে ইসরায়েলি সেনারা আল–আকসা মসজিদ চত্বরে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়।
ইসরায়েলের বর্তমান সরকারে থাকা এই বেন-গাভির ও অন্য ছয়জন উগ্রপন্থী নেতাই নেতানিয়াহুকে গদি হারানো থেকে এবং দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারেন। তাঁরা ভালো করে জানেন, নেতানিয়াহুও এটি জানেন এবং তাঁর সেই দুর্বলতার সুযোগ তাঁরা নিতে চান। তাঁরা জেরুজালেমে লাগাতারভাবে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে সহিংসতা চালিয়ে যেতে চান, যাতে আল–আকসা মসজিদের পবিত্র স্থানের সর্বজনস্বীকৃত মর্যাদা বাতিল হয়ে যায় এবং পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
নেতানিয়াহুও চান সেখানে সহিংসতা থাকুক। কারণ ষষ্ঠ দফায় গদিতে বসার পর ইসরায়েলের মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করছে, তা থেকে দৃষ্টি এই দিকে সহজেই ঘুরে যাবে। এটি মোটামুটি দৃশ্যমান যে বাইরের দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করা ইসরায়েলের আগ্রহের বিষয় নয়। ইসরায়েল বর্তমানে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সামলানো নিয়ে ব্যস্ত আছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক উপস্থিতি ও কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে তারা চিন্তিত। লেবানন সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততাও ইসরায়েলকে চিন্তায় ফেলেছে।
অন্যদিকে হামাস পশ্চিম তীর, জেরুজালেম ও ইসরায়েলে বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ করার পরিকল্পনা করায় ইসরায়েল চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আল–আকসায় যাতে ইসরায়েলের বাহিনী ঢুকতে না পারে, সে জন্য বিপুলসংখ্যক মুসল্লি হামাস জড়ো করতে চায়। অনেকে এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে নেতানিয়াহুর সরকার হয়তো এই আগ্রাসী আক্রমণ দিয়ে আল–আকসায় ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, যেটি তারা হেবরন শহরের (আগের নাম আল খলিলি) ইব্রাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রে করেছিল।
১৯৯৪ সালে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ইব্রাহিমি মসজিদে নামাজরত ২৯ মুসল্লিকে হত্যা করার পর ইসরায়েল ‘অধিকতর সহিংসতা ঠেকাতে’ মসজিদটিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে দুই ভাগ করে দিয়েছিল।
এ ধরনের ব্যবস্থা আল–আকসার ক্ষেত্রে নেওয়া হলে আল–আকসা আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানদের পবিত্র উপাসনালয়ের মর্যাদা হারাবে এবং সেটি হলে মুসলমানরা শুধু অনুমতি সাপেক্ষে এই মসজিদে কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে পারবে, কিন্তু নামাজ পড়তে পারবে না। তখন আল–আকসাকে গ্রাস করে ফেলা সহজ হয়ে যাবে।
এই অবস্থায় আরব দেশগুলো যদি ইসরায়েলকে না থামায়, তাহলে নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থী মিত্ররা আল–আকসা থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে আরও সাহসী হয়ে উঠবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ড. আদনান আবু আমের গাজার ইউনিভার্সিটি অব উম্মাহর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান