আন্তর্জাতিক আদালত কি রোহিঙ্গাদের সুবিচার দেবেন

আইসিজে তাঁর অস্তিত্বের সাত দশকে মাত্র দুটি গণহত্যা মামলার শুনানি করেছেন এবং রায় দিয়েছেন
ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের প্রধান বিচার বিভাগীয় অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, যা সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আইনি বিরোধ মোকাবিলা করে থাকে, সেই ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) গত শুক্রবার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যা মামলা ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টাকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। আদালত ফরাসি এবং ল্যাটিন ভাষায় লেখা প্রায় ৯ হাজার পৃষ্ঠার একটি রায় প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমার সরকারের আইনি দলের ‘এজেন্ট’ ও গণহত্যার পক্ষে প্রচার চালানো নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া সাবেক কর্নেল কো কো হ্লাইং এই মামলা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে যে চারটি প্রাথমিক আপত্তি দায়ের করেছিলেন, এই রায়ে তার সবগুলোকে কার্যকরভাবে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।

গাম্বিয়ার কৌঁসুলি হিসেবে আর্সালান সুলেমান ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আইসিজের এই রায়কে গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার আইনজীবী ও আন্দোলনকর্মীদের জন্য একটি ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘের আদালতের একটি হতাশাজনক রেকর্ড রয়েছে। সেটি হলো, আইসিজে তার অস্তিত্বের সাত দশকে মাত্র দুটি গণহত্যা মামলার শুনানি করেছেন এবং রায় দিয়েছেন। গণহত্যাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জেনোসাইড ওয়াচ-এর মতে, এর বাইরেও বেশ কয়েক ডজন মামলা রয়েছে, যা আইসিজেতে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃত হতে পারত।

সর্বশেষ রায়ের মধ্য দিয়ে মামলাটি যেহেতু আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল এবং তা ‘মেরিট’ বা আমলযোগ্যতায় উতরে যাওয়ার স্তরে পা রাখল, সেহেতু গাম্বিয়ার সামনে একটি দূরতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ অত্যাসন্ন। গাম্বিয়াকে সেই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতেই হবে। গণহত্যা সনদের (জেনোসাইড কনভেনশন) ব্যাখ্যা অনুযায়ী যখন কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, শুধু তখনই আদালত গণহত্যার বিষয়ে রুলিং দিতে পারবেন, অন্যথায় নয়। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে পড়ে এমন রাষ্ট্রীয় অপরাধসহ অন্য কোনো ধরনের অপরাধ করার অভিপ্রায়কেও আদালত গণহত্যার রুলিংয়ে আমলযোগ্য মনে করেন না।

আদালতের এই অতি রক্ষণশীল অবস্থা, যেটিকে কম্বোডিয়ার জেনোসাইড ডকুমেন্টেশন সেন্টার এবং জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন ‘একক অভিপ্রায় তত্ত্ব’ (সিঙ্গেল ইনটেন্ট থিওরি) বলে অভিহিত করেছেন, সেটি আমার বিবেচনায় বুদ্ধিবৃত্তিক পাগলামি এবং একটি প্রায়োগিক মিথ্যা। কারণ, সংগঠিত মানুষের অপরাধ সাধারণত বহুবিধ উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় দ্বারা চালিত। এই মৌলিক সত্যটি সামাজিক বিজ্ঞানের যেকোনো স্নাতক জানেন। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা গাম্বিয়া বা আদালত এখনো বিবেচনায় আনেননি। তা হলো মিয়ানমারের এজেন্টদের বৈধতা এবং যোগ্যতা। মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সত্যিকার অর্থে বৈধতা আছে কি না, সেটা নিয়ে আদালত বা গাম্বিয়া এখনো প্রশ্ন তোলেনি। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাসকদের তাদের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে দেখে না। গত বসন্ত থেকে জনগণ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে সেটা দেখিয়েও দিয়েছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে দুই হাজার নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ১৫ হাজার আন্দোলনকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ‘দল পাকানোর অপরাধে’ কারাগারে ঢোকানো ও নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিবাদী জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নৃশংস প্রোপাগান্ডাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অসংখ্য অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ জাতিসংঘের মিয়ানমার সংক্রান্ত সংস্থা ইনডিপেনডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম ফর মিয়ানমার (আইআইএমএম) কর্তৃক নথিভুক্ত হয়েছে।

অধিকন্তু অভ্যুত্থানের কারণে উদ্ভূত সশস্ত্র প্রতিরোধ ও দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন চালানোর ফলে প্রায় আট লাখ বেসামরিক নাগরিককে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যের যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেখানে আটকা পড়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত আদালত জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে অবৈধ শাসকের প্রতিনিধিদের গ্রহণ করার পেছনে আইনি যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান ও অসম্মান করার শামিল। বিরক্তিকরভাবে জাতিসংঘ এবং সাধারণ পরিষদসহ এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত কিছু শাসককে ‘সত্যিকারের প্রতিনিধি’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে।

মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাসকদের তাঁদের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে দেখেন না। গত বসন্ত থেকে জনগণ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে জান্তাদের গদিচ্যুত করার চেষ্টা করছেন। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে তাঁরা ব্যালটের মাধ্যমে সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছিলেন। ওই ভোটে সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রক্সি দেওয়া রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ভরাডুবি হয় এবং দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জনগণের সমর্থন পায়।

সামরিক শাসক হেগে মিয়ানমারের এজেন্ট (বা মিয়ানমারের আইনি প্রতিনিধি) হিসেবে যাঁদের পাঠিয়েছে, তাঁরা এমনভাবে সেখানে দেনদরবার করেছেন, যেন তাঁরা মিয়ানমার রাষ্ট্রটির তথা সেখানকার সব মানুষের প্রকৃত প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। আইসিজেতে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার গণহত্যা মামলাটির সুযোগ এবং আমলযোগ্যতার বাইরে, মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। এটিকে বুদ্ধিবৃত্তিক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এবং এখন পর্যন্ত আদালত জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে অবৈধ শাসকের প্রতিনিধিদের গ্রহণ করার পেছনে আইনি যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান ও অসম্মান করার শামিল। বিরক্তিকরভাবে জাতিসংঘ এবং সাধারণ পরিষদসহ এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত কিছু শাসককে ‘সত্যিকারের প্রতিনিধি’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে।

কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ শাসক টানা ১২ বছর ধরে গণহত্যার ঘটনা ঘটানোর পরও খেমাররুজ শাসককে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কম্বোডিয়ার আসন ধরে রাখতে ইউনেসকোতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার এবং কোনো নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই ভ্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এসব সম্ভব হয়েছিল ভেটো দেওয়ায় সক্ষম তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং চীনের বদৌলতে।

শিবিরে বেঁচে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য সত্যিকারের ন্যায়বিচারের অর্থ অবশ্যই জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের ওপর আইসিজের রায় নয়; বরং এর মানে অবশ্যই বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ভারত ও পাকিস্তানে আইনবহির্ভূত ও অমানবিক অবস্থার মধ্যে থাকা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন।

ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মং জার্নি যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী