গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ অন্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে
গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ অন্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে

মতামত

যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র আন্দোলন যে সত্যকে সামনে এনেছে

আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি দিই, তা হলো সেই মানুষদের খুঁজে বের করো, যারা তোমাদের থেকে দ্বিমত পোষণ করে। এর কারণ হলো, শিক্ষার একেবারে গোড়ার বিষয় হলো একজনের ধারণা, অনুমান ও মূল্যবোধকে পরীক্ষা করা। কারও ধারণা, অনুমান আর মূল্যবোধ পরীক্ষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথায়?

এটা স্পষ্ট যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিনোশে শাফিক আমার এই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন না। গত সপ্তাহে তিনি হাউস রিপাবলিকানস–এ গিয়ে নতজানু হন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন, গাজার চলমান গণহত্যা নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

উল্লেখ্য, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় এ পর্যন্ত ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। পরের দিনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে ডেকে আনেন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ১০০-এর বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ।

আমরা কি কিছু বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারি? গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মানেই সেমেটিকবিরোধী (ইহুদিবিদ্বেষী) মনোভাব প্রকাশ করা নয়। এই প্রতিবাদের সঙ্গে হেইট স্পিচ বা ঘৃণাব্যঞ্জক বক্তব্যের কোনো সম্পর্ক নেই।

এই প্রতিবাদ ইহুদি শিক্ষার্থীদের বিপদের মুখে ফেলছে না। একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে দাঁড়ানোর কথা, এখানে সেটাই ঘটেছে। এটি আলোচনা আর বিতর্ককে উসকে দিয়েছে।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ খুবই ভয়ংকর একটা ঘটনা। দুই পক্ষই এমন নৃশংসতা দেখিয়েছে যে যেটা মানুষের পক্ষে কতটা অমানবিক হওয়া যায়, তারই প্রদর্শন। এ কারণে এই সংঘাত শিক্ষার্থীদের সামনে তঁাদের পূর্ববর্তী ধারণা নতুন করে পরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছে। একে অপরের কাছ থেকে শেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

এখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যদি আন্দোলন করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যুদ্ধ নিয়ে বিতর্কের উর্বর ক্ষেত্র হওয়া উচিত। অবশ্যই দ্বিমতকে স্বাগত জানানো, বিক্ষোভকে গ্রহণ করা, যুক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো এবং ভিন্নতাকে পরীক্ষা করা উচিত।

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশন হওয়া উচিত শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিখবে সেই পথ বাতলে দেওয়া, তারা কী চিন্তা করবে, সেটা বলে দেওয়া নয়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ককে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে, বিতর্ককে চাপা দেওয়া যাবে না। মনে রাখা দরকার, সত্য একটা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি—এটা যতটা নামপদ, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্রিয়াপদ।

আমার কোনো শিক্ষার্থী কিংবা অন্য কোনো শিক্ষার্থী যখন বলে ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নই’ এবং কী কারণে সে একমত নয়, তার ব্যাখ্যা দেয়, আমি সেটা ভালোবাসি। এই দ্বিমতই চিন্তা ও আলোচনার জন্ম দেয়। এটা শিক্ষার্থীদের তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাদের আরও গভীর অনুসন্ধিৎসু করে তোলে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তচিন্তার চর্চাকে সুরক্ষা দেওয়ার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের আছে। আমি মনে করি, এটা তাদের দায়িত্ব। শাফিকের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানানোর অধিকার ও দায়িত্ব তাদের রয়েছে। ইয়েল, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত দমন না করে সেই আন্দোলন থেকে শেখা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত অজনপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে উৎসাহিত করা এবং সুরক্ষা দেওয়া। ক্যাম্পাসে নিতান্তই অসতর্কতাবশত যেসব ‘মামুলি আগ্রাসনের’ (বয়স, লিঙ্গ, হাঁটাচলা কিংবা অন্য কোনো অন্য বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা) ঘটনা ঘটে, তা থেকে শিক্ষার্থীদের ঢাল তৈরি করে রক্ষা করার দরকার নেই। এর কারণ হলো, এতে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হতে পারে, তাদের মধ্যে নতুন ধারণা জন্ম হতে পারে। 

ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিকে উৎসাহিত করা উচিত, সেটা বন্ধ করে দেওয়া নয়। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশ ডেকে আনা ও গ্রেপ্তার করা মোটেই ঠিক কাজ নয়।

পরিশেষে বলব, কিছু মানুষের জন্য অস্বস্তিকর হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের মতপ্রকাশের সহিষ্ণু পরিবেশ নিয়েই থাকা উচিত। সমস্ত প্রতিবাদী বক্তব্যকে ‘ঘৃণা বক্তব্য’ বলে তকমা দেওয়া এবং সেটা নিষিদ্ধ করার মানে হচ্ছে শিক্ষার কেন্দ্রীয় স্তম্ভকেই হাওয়া করে দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই জোরালোভাবে কথা বলার পরিবেশ থাকতে হবে।

কিন্তু অবশ্যই এ ক্ষেত্রে সীমারেখা থাকতে হবে। কোনো একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করে যদি মতামত প্রকাশ করা হয়, প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য যদি প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়, কাউকে যদি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়, তাহলে সেটাকে স্বাগত জানানো যাবে না। এটা একধরনের নিপীড়ন। এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।

আমার বয়স যথেষ্ট হয়েছে এবং অনেক বছর ধরে অধ্যাপনা করে আসছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভে ফেটে পড়ার অনেক ঘটনা আমি দেখেছি। ধর্মান্ধ জর্জ ওয়ালেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে চাওয়া, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো ঘটনায় প্রতিবাদ হতে আমি দেখেছি।

এসব প্রতিবাদের অনেকগুলোই ছিল জোরালো। কিছু প্রতিবাদের সময় ঝামেলাও হয়েছে। কিছু প্রতিবাদের সময় প্রতিবাদকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখেছি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা ছিলেন অহিংস।

কোনো একজন ছাত্রের ক্ষতি করা ও নিপীড়ন করার মতো ঘটনা সেখানে ঘটেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন পুলিশ ডেকে এনেছে, শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করেছে, তখন সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে মুক্তচিন্তাচর্চাকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেই ভূমিকা পালন করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রেসিডেন্ট ও ট্রাস্টিদের কাজ অবনমন হতে হতে মূলত তহবিল সংগ্রহকারীর পর্যায়ে নেমে গেছে। সম্পদশালী সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেই তহবিল সংগ্রহ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কথা বলা যাবে আর কোন কথা বলা যাবে না, সেটা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরাই।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তচিন্তার চর্চাকে সুরক্ষা দেওয়ার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের আছে। আমি মনে করি, এটা তাদের দায়িত্ব। শাফিকের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানানোর অধিকার ও দায়িত্ব তাদের রয়েছে।

ইয়েল, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত দমন না করে সেই আন্দোলন থেকে শেখা।

রবার্ট রাইশ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শ্রমমন্ত্রী এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জননীতি বিষয়ে অধ্যাপক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে