গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে এই যুদ্ধবিরতির সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন আলী রীয়াজ
যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকার থেকে দক্ষিণপন্থীরা সরে যাবে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরায়েল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন।
গাজায় যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপস্থাপন করেছেন ও যা গ্রহণে কার্যত আপত্তি নেই বলে হামাস জানিয়েছে, সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের যে হামলার সূচনা হয়েছে, তার অবসান ঘটানোই এই যুদ্ধবিরতির লক্ষ্য।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনো আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা অপরাহ ফক স্থানীয় সময় সোমবার সকালে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে ইসরায়েল এই প্রস্তাবে রাজি আছে। কিন্তু তিনি এটাও বলেন, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য বিস্তারিত অনেক কাজ করতে হবে। তদুপরি তাঁর ভাষায় ইসরায়েলের দুটি শর্ত অপরিবর্তিত আছে—সব জিম্মির মুক্তি ও ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হামাসের ধ্বংস।
এই বক্তব্য যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে হামাসের সঙ্গে ঐকমত্য না হওয়ার উদ্দেশ্যে যতটা করা হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি হচ্ছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা। ইতিমধ্যে এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে এই কারণে যে নেতানিয়াহু দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের দেওয়া প্রস্তাবের ‘আংশিক’ বলেছেন। ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা এমন মন্তব্যও করেছেন, বাইডেন যাকে ইসরায়েলের প্রস্তাব বলছেন, তা ‘সঠিক নয়’।
ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা, বিরতিহীন, অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও ইসরায়েলের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নেই বললেই চলে।
বাইডেন গত শুক্রবার যা ঘোষণা করেছেন, তা আসলে ইসরায়েলের প্রস্তাব। এই প্রস্তাব মধ্যস্ততাকারীদের মাধ্যমে হামাসের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন। এই প্রস্তাব দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ অবসানের ইঙ্গিত দেয় না এবং তা যে ইসরায়েলের স্বার্থের পরিপন্থী, তা–ও নয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রস্তাব মেনে নিতে নেতানিয়াহুর অনাগ্রহের কারণ হচ্ছে, যেকোনো ধরনের যুদ্ধবিরতির অর্থ হচ্ছে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যে এই যুদ্ধে ইসরায়েলের কী লাভ হলো। এই প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠবে, কেননা এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে গাজা থেকে সব ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কয়েক মাস ধরেই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নাগরিকেরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এবং যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে জিম্মিদের ফেরত আনতে হামাসের সঙ্গে চুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকার থেকে দক্ষিণপন্থীরা সরে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে তাঁর সরকারের পতন।
স্মরণ করা দরকার যে ২০২২ সালে নেতানিয়াহুর সরকার আসে পূর্ববর্তী চার বছরে চারটি নির্বাচনে কোনো ধরনের শক্তিশালী কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে। পার্লামেন্টের ১২০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের সরকারের আসন ৬৪টি।
এই মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নেতনিয়াহুর দল লিকুড পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা কম। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারলে নেতানিয়াহুকে তাঁর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির মামলা মোকাবিলা করতে হবে। এই মামলা আদালতে অব্যাহত আছে, কিন্তু যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে এই বিষয়ে গত বছর নাগরিকদের যে সোচ্চার প্রতিবাদ জারি ছিল, তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধবিরতি ঘটলে এবং তা অব্যাহত থাকলে কেবল যে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভাগ্যই প্রশ্নের মুখোমুখি হবে, তা নয়, ইসরায়েলের নাগরিকদের কাছে তখন সহজেই বোধগম্য হবে যে এই যুদ্ধে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কমপক্ষে সাড়ে ৩৬ হাজার ফিলিস্থিনি নিহত হয়েছেন, লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। কিন্তু এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পরাজয় ঘটেছে।
হামাসের আক্রমণে যে ১ হাজার ১৩৯ ইসরায়েলি নাগরিকেরা নিহত হয়েছেন, যাঁরা জিম্মি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন, কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে যে কয়েক শ সৈন্য মারা গেছেন, তাঁদের মৃত্যু সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরায়েল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিককালে ইউরোপের তিনটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন অবস্থাদৃষ্টে এমন বলাই যথাযথ যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং পশ্চিমের কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো দেশের সংখ্যা হাতে গোনা যায়।
ইসরায়েলের অনুসৃত নীতি এখন পৃথিবীর বিরাটসংখ্যক মানুষের কাছেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পরিণত হয়েছে এবং গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতা ‘গণহত্যা’ বলেই বিবেচিত হচ্ছে। সম্ভবত এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না, এই যুদ্ধের ফলে কেবল ফিলিস্তনিদের পক্ষেই সমর্থন বেড়েছে, তা নয়, হামাসও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করার নামে যে অভিযান চালিয়েছে, সেই অভিযানের ফল হয়েছে হামাসের প্রতি একধরনের সহানুভূতি তৈরি হওয়া। ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী রাজনিতিবিদ এবং সামরিক কৌশলপ্রণেতারা হামাসকে বাদ দিয়ে গাজায় যে শাসনের কথা এখনো বলছেন, তা আসলে এক অবাস্তব কল্পনামাত্র। সেটা যুদ্ধের সূচনায় যেমন স্পষ্ট ছিল, এখনো তেমনি সত্য। (‘হামাস ধ্বংস হলে গাজার ক্ষমতায় থাকবে কে’, প্রথম আলো, ১৭ অক্টোবর ২০২৩)। শুধু তা–ই নয়, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আদালতেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতিকে কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলি সরকারের যে একধরনের টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে, তার কারণ এটা মনে করার অবকাশ নেই যে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। এই টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন চান যে সাময়িকভাবে হলেও এই যুদ্ধের অবসান দরকার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে।
ডেমোক্রেটিক পার্টির একটা অংশ এখন উপলব্ধি করতে পারছেন যে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্রমেই সমস্যা—সংকুল হয়ে উঠেছে। যদিও ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থনের ব্যাপারে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্ব ও রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে ফারাক নেই বললেই চলে।
কংগ্রেসে দুই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য একই অবস্থান গ্রহণ করা সত্ত্বেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ইসরায়েলের এই ‘সামরিক পদক্ষেপের’ প্রতি সমর্থন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে গ্যালপের করা জরিপে দেখা গিয়েছিল যে ৫০ শতাংশ মানুষ সমর্থন করে, বিরোধিতা করে ৪৫ শতাংশ মানুষ। মার্চ মাসে সেটা দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশ বিরোধিতা করে, সমর্থন করে ৩৬ শতাংশ মানুষ। মে মাসের গোড়াতে এবিসি টেলিভিশনের করা জনমত জরিপে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের পক্ষে যা করছে, তা অতিরিক্ত বলে মনে করেছে ৪০ শতাংশ মানুষ, যা জানুয়ারির তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
জনমতের এই পরিবর্তনের পাশাপাশি যা ঘটছে, তা একার্থে অভূতপূর্ব। ৭ এপ্রিল থেকে ২১ মে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। গ্রীষ্মকালের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে এখন এই বিক্ষোভগুলো শেষ হয়েছে। কিন্তু এই বিক্ষোভগুলো যুক্তরাষ্ট্রে যা কিছু দিন আগেও ছিল প্রায় ট্যাবুর মতো বিষয়, কিংবা যা ছিল সংখ্যালঘুদের মধ্যকার আলোচনার বিষয়, তা এখন মূল ধারায় চলে এসেছে।
এটা হচ্ছে প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে ফিলিস্তিন বিষয়ে তার নীতির সমালোচনা। এগুলোকে মার্কিন গণমাধ্যম এবং রাজনীতিবিদের একাংশ ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ বলে বর্ণনা করলেও এর প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করার কোনো উপায় আর নেই।
এই সূত্রে তরুণ সমাজ, মুসলিম ও আরব জনগোষ্ঠীর ভেতরে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, তা বাইডেনের পুনর্নির্বাচনের পথে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে তার প্রতি অনুগতদের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এখন এই বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের একধরনের নমনীয় অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু বাইডেন বা তাঁর প্রশাসন যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নিতে পারবে না, সেটা সবার জানা।
গাজার এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা, বিরতিহীন, অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও ইসরায়েলের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং যেই দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সামরিক সাহায্য করে থাকে, তাঁর ওপর বাইডেন প্রশাসনের কোন ধরনের প্রভাব না থাকাকে কেবল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা বলেই মনে করা হচ্ছে, তা নয়, বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা বলেও দেখা হচ্ছে।
এটি বাইডেন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্যে একটা বড় ধরনের নেতিবাচক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। মার্কিন নির্বাচনে দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে না, এত দিনের এই ধারণা সম্ভবত এখনো সঠিক। কিন্তু সেই পররাষ্ট্রনীতি যখন দেশের ভেতরে ভোটারদের ভেতরে একধরনের অস্বস্তি তৈরি করে, তখন তা ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ১৯৬৮ সালের নির্বাচন তার একটা উদাহরণ।
গাজায় মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত আছে, ইসরায়েলি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড চলছেই, মানবিক বিপর্যয় চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সেখানকার অধিবাসীরা খাদ্য ও চিকিৎসা–সুবিধা বঞ্চিত বললে সামান্যই বলা হয়। কিন্তু এর শেষ কবে হবে, অন্তত সাময়িকভাবে তাতে বিরতি ঘটবে কি না, সেটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এখন প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠেছে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। এই পরিস্থিতিকে দুর্ভাগ্যজনক বলাই যথেষ্ট নয়, অমানবিক বলাই যথাযথ।
আলী রীয়াজ ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি