ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্প ভয় পান যে দুটি বিষয়ে

ইতিহাসে নতুন একটি জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বসাতে নিউইয়র্ক জুরির ৯ ঘণ্টার সামান্য কিছু বেশি সময় লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ট্রাম্প নিজেকে বেশ আগেই এমন একজন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যিনি গুরুতর অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। আর এখন তিনিই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন। 

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এখনো তিনটি গুরুতর মামলা চলমান। সেগুলোর কোনোটিতেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি। কুখ্যাত আমেরিকান ব্যবসায়ী ও গ্যাংস্টার আল ক্যাপোনের (ট্রাম্প গর্বভরে যাঁর সঙ্গে নিজের তুলনা করে থাকেন) মতো ট্রাম্পের তুলনামূলক ছোট একটি মামলা বৃহস্পতিবার নিষ্পত্তি হলো। এর মধ্য দিয়ে আইন তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল। 

এখানেই ঘটনার শেষ—এমনটা মনে করতে পারলে সত্যিই ভালো হতো। ট্রাম্পের দিন শেষ হয়েছে এবং তাঁর হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সব আশা শেষ হয়ে গেছে—বিশ্ব স্বাভাবিকভাবে চললে এ কথায় কেউ দ্বিমত করত না। 

একটি স্বাভাবিক বিশ্বে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলে ‘অবশ্যই’ বলতাম, ‘আমেরিকানরা কখনোই তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন অপরাধীকে নির্বাচিত করবে না। ১৯৮৮ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিক নিল কিনকের বক্তব্য চুরি করে নিজের ভাষণে চালিয়ে দেওয়ার কারণে জো বাইডেনকে যে ভোটাররা অযোগ্য ঘোষণা করেছিল; সেই ভোটাররা বাইডেনের চেয়ে অন্তত ৩৪ গুণ অন্যায় করা অপরাধীকে হোয়াইট হাউসে পাঠাবে, এটা হতেই পারে না।’ 

কিন্তু কথা হচ্ছে সেই স্বাভাবিক বিশ্বকে আমরা অনেক আগেই অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। বাস্তবতা হলো, আজকের ‘ট্রাম্পওয়ার্ল্ডে’ ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা রায় তাঁর সহানুভূতি কুড়ানোর হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে; তাঁর নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের সুযোগ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সাবেক এই প্রেসিডেন্টের অনুচরেরা এখন তাঁদের সেই রাজনৈতিক প্যাটার্নের দিকে ঝুঁকবে যা তাঁরা একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। 

ট্রাম্পের অনুসারীরা ট্রাম্পের ওপর আসা আইনি আঘাতকে রিপাবলিকান প্রাইমারি চলাকাল থেকে চক্রান্ত হিসেবে দেখাচ্ছেন। রিপাবলিকান প্রাইমারি থেকে ট্রাম্প নিজেকে রাষ্ট্রক্ষমতার গভীরে থাকা উদারপন্থীদের চক্রান্তের শিকার হিসেবে দাবি করে আসছেন। 

বর্তমানে যিনি বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তিনি ২০২০ সালে হেরে গিয়ে ভোটের ফল উল্টে দিতে চেষ্টা করেছিলেন এবং আদালতের ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালে তিনি নির্বাচনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এবার তিনি ভোটে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে গেছেন। কারণ, একমাত্র আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের জয়ই তাঁকে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। 

সুতরাং ট্রাম্পের যেকোনো সাজাকে ‘টিম ট্রাম্প’ আদালতের অবিচার বলে প্রচার করতে থাকবে। অর্থাৎ ট্রাম্প যত বড় অন্যায়ই করুন না কেন, তাঁর ভক্ত ও সমর্থকদের কাছে তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা কমবে না বলে ধারণা করা যেতে পারে। কেননা ট্রাম্প একবার নিজের মুখে বলেছিলেন, তিনি যদি ফিফথ অ্যাভিনিউতে ‘কাউকে গুলি করেন’, তা হলেও তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে ছেড়ে যাবেন না। 

তা সত্ত্বেও, এই রায় ঘোষণার পর আপনি ট্রাম্প এবং তাঁর উপদেষ্টাদের চেহারায় চিন্তার রেখা দেখতে পাবেন। কারণ তাঁরা ভালো করেই জানতেন, ১৫৩০ নম্বর বিচারকক্ষে ১২ জন বিচারক যে রায় দিয়েছেন, তা জো বাইডেনের জন্য প্রাণসঞ্চারী হয়ে উঠেছে। 

প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা নিয়ে যেসব জরিপ হয়েছে, সেসব জরিপে বাইডেনের অবস্থা খুবই খারাপ দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয় পেতে হলে জিততেই হবে, এমন ছয়টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পাঁচটিতে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে পেছনে রয়েছেন। যে কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো এবং তরুণ ভোটারদের ভোট পেয়ে ২০২০ সালে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবার তিনি জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। 

অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমেরিকানরা বাইডেনের চেয়ে এখন ট্রাম্পের ওপর বেশি আস্থাশীল। এক জরিপ বলছে, ৪৬ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন ট্রাম্পের ওপর আর্থিক অগ্রগতির ইস্যুতে আস্থা রাখা যায়। অন্যদিকে একই ইস্যুতে ৩১ শতাংশ আমেরিকান বাইডেনের ওপর ভরসা রাখতে পারছে। 

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও একটি সান্ত্বনা পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন রিপাবলিকান ভোটারের মধ্যে প্রায় একজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে, যাঁরা বলেছেন তাঁরা ট্রাম্পের প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্বিবেচনা করবেন অথবা যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করবেন। এখন যেহেতু রায় হয়ে গেছে, সেহেতু বলা যায়, সেই দিন এসে গেছে। 

তবে জনপ্রিয়তা বাইডেনের কাছে হেঁটে এসে ধরা দেবে না। এই রায়ের মাধ্যমে জো বাইডেনের জন্য যে দরজা খোলা হয়েছে, তাঁকে তার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। অর্থাৎ রিপাবলিকানদের মধ্যে যাঁরা ভিন্নমত পোষণকারী, তাঁদের কাছে বাইডেনের সরাসরি আবেদন করতে হবে; তাঁদের দলীয় আনুগত্য ভাঙতে এবং বাইডেনকে তাঁদের ভোট দিতে অনুরোধ করতে হবে।

 তবে অবিশ্বাস্যভাবে বাইডেন এখন পর্যন্ত তা করার কোনো চেষ্টাই করেননি। সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ক্রিস ক্রিস্টি, যিনি জানুয়ারিতে ট্রাম্পের ওপর উত্তেজনাপূর্ণ আক্রমণ করে নির্বাচনী দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছিলেন, তিনি এ সপ্তাহে বলেছেন, বাইডেন বা তাঁর দলের কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বা তাঁর সমর্থন এমনকি পরামর্শও চাননি। এটি বাইডেনের অত্যধিক আত্মতুষ্টিকে আমাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। 

ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া রায় বাইডেনকে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এনে দিলেও এই বিষয়টিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিপদের ঝুঁকিও আছে। রায়ের পয়েন্টটির ওপর খুব বেশি চাপাচাপি করলে ট্রাম্পবাদীরা এমন একটি ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারে যে ম্যানহাটানের বিচার একটি পক্ষপাতমূলক ‘উইচ হান্টের’ অংশ, যেখানে বাইডেন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য বিচারব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছেন। 

বাইডেন এমন কিছু বলতে পারবেন না, যা থেকে মনে হতে পারে তিনিই ট্রাম্পের আইনি পতনের মূল অনুঘটক। সে ক্ষেত্রে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না থাকার বিষয়ে নিরপেক্ষ বক্তব্য দিয়ে যাওয়াই বাইডেনের জন্য ভালো হবে। আমি মনে করি, ২০২৪ সালের এই নির্বাচনকে একটি স্বাভাবিক ও গতানুগতিক নির্বাচন বলে মনে করার সুযোগ নেই। এটা সম্পূর্ণ আলাদা কিছু।

বর্তমানে যিনি বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তিনি ২০২০ সালে হেরে গিয়ে ভোটের ফল উল্টে দিতে চেষ্টা করেছিলেন এবং আদালতের ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালে তিনি নির্বাচনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এবার তিনি ভোটে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে গেছেন। কারণ, একমাত্র আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের জয়ই তাঁকে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। 

চলতি মাসে ক্রিস্টি বলেছেন, ট্রাম্প তাঁর নিজের কোমর ভেঙে যাওয়াকে যতটা ভয় পান, সেভাবেই জেলে যাওয়ার বিষয়টিকে ভয় পান। এমন একজন ব্যক্তির পুনরায় ক্ষমতায় আসাটা আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এবং আইনের শাসনের জন্য মহাবিপদের বিষয়। এর চেয়ে গুরুতর বিপদ আর হতে পারে না। 

কিন্তু সেই বিপদ সম্পর্কে ভোটারদের সতর্ক করাই যথেষ্ট বলে মনে হয় না। এই প্রতিযোগিতায় একটি স্মার্ট প্রচারণা এবং জনগণকে রুটি-রুজির বার্তা দিয়ে বাইডেনকে জিততে হবে। 

এ কারণে নিশ্চিত করে বলা যায়, হ্যাঁ, সেই ১২ জন বিচারক সত্যি সত্যি জো বাইডেনকে একটি প্রাণসঞ্চারী পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই পথ তাঁকেই দখল করতে হবে। 

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড গার্ডিয়ান–এর নিয়মিত কলাম লেখক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ