মতামত

কর্ণাটকে কি মোদি–ম্যাজিক অটুট না কংগ্রেস জাগছে?

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

আগামী পাঁচ সপ্তাহ ভারতের রাজনীতি আবদ্ধ থাকবে দক্ষিণি রাজ্য কর্ণাটকে। ১০ মে এ রাজ্যের বিধানসভার ২২৪টি আসনে ভোট। ফল বেরোবে ১৩ মে। সেদিনই বোঝা যাবে প্রায় এক দশক ধরে জাতীয় রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা নরেন্দ্র মোদির জনমোহিনী আকর্ষণ কতটা অটুট রয়েছে। একই সঙ্গে বোঝা যাবে বিজেপিকে আগামী দিনে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে কংগ্রেস কতখানি সংঘবদ্ধ।

গোবলয়ের রাজ্যগুলোতে বিজেপি যত শক্তিশালী, কর্ণাটকে অবশ্যই ততটা নয়। উত্তর প্রদেশ বা গুজরাটের মতো প্রায় ফাঁকা মাঠে গোল তারা দক্ষিণের এ রাজ্যে দিতে পারে না। এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য কর্ণাটকের কংগ্রেস উত্তরের মতো শক্তিহীন নয়। চার বছর আগে বিজেপির চাতুর্যের কাছে দলটা পরাস্ত হয়েছিল। জেডিএসের (জনতা দল সেক্যুলার) সঙ্গে তাদের মিলিজুলি সরকারের পতন ঘটেছিল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই।

সেই হারানিধি নতুন করে ফিরে পেতে এবার তারা মরিয়া। সফল হলে চলতি বছরের শেষে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের ভোটও উত্তেজনার খই ফোটাবে। বিরোধী ঐক্যের যে হাওয়া ক্ষীণ হলেও বইতে শুরু করেছে, তাতে তেলেঙ্গানাও যদি বিজেপির কাছে অধরা থেকে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই পাঁচ রাজ্য বিজেপিকে আশাহত করলে কিংবা অন্য দিক থেকে দেখলে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের হাত শক্ত করলে পরের বছর লোকসভা ভোট টানটান হয়ে উঠবে।

ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার দিনেই দুটি সংস্থা কর্ণাটক নিয়ে জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে। এবিপি নিউজ–সি ভোটার সমীক্ষা বলছে, কংগ্রেস এবার একাই ক্ষমতা দখল করবে। এদের জরিপ অনুযায়ী কংগ্রেস পেতে পারে ১১৫ থেকে ১২৭টি আসন। বিজেপির আসনসংখ্যা ১১৯ থেকে নেমে যেতে পারে ৬৮ থেকে ৮০–তে। জেডিএস পেতে পারে ২৩ থেকে ৩৫টি আসন। ‘জি’ নিউজের সমীক্ষায় বিজেপি একক গরিষ্ঠ দল থাকবে। আসন কমে হবে ৯৬–১০৬। কংগ্রেস পাবে ৮৮–৯৮ আসন। জেডিএস ২৩–৩৩। এ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী রাজ্যের ৫৯ শতাংশ জনতা মনে করছে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কংগ্রেসের পালে হাওয়া জুগিয়েছে। আবার ৭৯ শতাংশ জনতা মোদি সরকারের প্রকল্পে সন্তুষ্ট।

মোদি–আদানি সম্পর্ক, রাহুলের সংসদ সদস্য পদ খারিজ, ইডি–সিবিআই–আয়কর বিভাগের ‘আতঙ্ক সৃষ্টি’, সার্বিক ‘গণতন্ত্রহীনতা’ ও শাসকের ‘স্বৈরাচারিতা’ জাতীয় স্তরে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তার পরিণতি আগামী দিনে কেমন হতে পারে, সে প্রশ্নের জবাব কর্ণাটক থেকেই আসতে চলেছে। আগ্রহের অবসান ঘটতে বাকি মাত্র দেড় মাস।

মোদি সরকারের প্রকল্পে বেশির ভাগ মানুষ সন্তুষ্ট হলে পালাবদলের জন্য কেন কংগ্রেসকে আবাহন করছে? এ প্রশ্নই মোক্ষম। এর মধ্য দিয়ে যে অনাস্থার প্রকাশ ঘটছে, তার সম্পূর্ণ দায় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের। চার বছর ধরে নরেন্দ্র মোদিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা রাজ্য নেতৃত্বের ওই মলিন ভাবমূর্তি ফেরাতে ব্যর্থ। দুর্নীতির যে অভিযোগে সরকার বিব্রত ও বিড়ম্বিত, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তার মোকাবিলা করতে পারেনি। সরাসরি ঘুষের টাকা নেওয়ার অপরাধে ধরা পড়েছেন বিজেপি বিধায়ক ও তাঁর পুত্র।

রাজ্যের ১৩ হাজার স্কুলের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার না করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি রাজ্য সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। মোদিজির ওপর ভরসা রাখুন। জিতলে দুর্নীতিমুক্ত সরকার আমরাই উপহার দেব।’

চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না মোদি–শাহ জুটি। প্রধানমন্ত্রী এ বছরে ইতিমধ্যে আটবার রাজ্য সফর করেছেন। নিজের তৈরি নিয়ম ভেঙে অশীতিপর নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা সংসদীয় বোর্ডের সদস্য করেছেন। অবিসংবাদিত এ লিঙ্গায়েত নেতাকে প্রচারে সামনে নিয়ে এসেছেন। ধর্মীয় মেরুকরণ চূড়ান্ত করতে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ৪ শতাংশ সংরক্ষণ কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে।

হিজাব–আজান বিতর্কের রেশ ধরে রেখে রাজ্য সভাপতি জানিয়েছেন, এবারের লড়াই টিপু সুলতানের বংশধরদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা সাভারকরের অনুগামীদের। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের মতো কর্ণাটকের রাজনীতিও প্রধানত জাতভিত্তিক। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুই প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায় লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগার বাইরে রয়েছে দলিত, তফসিল ও অনগ্রসরভুক্তরা। আর আছে মুসলমান সম্প্রদায়।

রাহুল গান্ধীর ‘মোদি’ পদবি বিতর্ককে বিজেপি ‘অনগ্রসরদের অপমান’ বলে ব্যাপক প্রচারে নেমেছে। কর্ণাটকে এ অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে তফসিল–অনগ্রসর সমাজের অদ্বিতীয় নেতা কংগ্রেসের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার প্রভাব খাটো করতে। কর্ণাটকে সিদ্দারামাইয়া যেমন অনগ্রসর, তেমনই অনগ্রসর রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ও ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল।

কংগ্রেসের হয়ে আসরে নামছেন রাহুল নিজেই। এত দিন রাজ্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকা রাহুল ঠিক করেছেন কর্ণাটকে চরকি ঘোরা ঘুরবেন। কোলার জেলার যে ময়দানি ভাষণের জেরে আজ তিনি ‘সাবেক সংসদ সদস্য’, সেখান থেকেই বুধবার শুরু করবেন কংগ্রেসের কর্ণাটক বিজয় অভিযান। আসরে নামছেন প্রিয়াঙ্কাও।

কর্ণাটক জয়ের তাৎপর্য কতটা, কংগ্রেস তা উপলব্ধি করছে। জাতভিত্তিক বিন্যাসে ভারসাম্য রাখতে ভোক্কালিগা ও অনগ্রসরদের পাশাপাশি ভূমিপুত্র দলিত মল্লিকার্জুন খাড়গেকে সভাপতি বেছে নেওয়া এক বড় পদক্ষেপ। এঁদের সঙ্গে মুসলমান সমর্থন ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হিসেবে কাজ করলে বিজেপি ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরতে পারে।

কর্ণাটক সম্পদশালী রাজ্য। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ৮ শতাংশ এ রাজ্যের অবদান। বায়োপ্রযুক্তি, বিমান পরিবহন, প্রতিরক্ষা উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন শিল্প, কৃষি ও পর্যটনে এ রাজ্যের অবস্থান প্রথম সারিতে। এ রাজ্য দখল করার অর্থ প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় শক্তিধর হওয়া। যুযুধান দুই শিবিরই তাই এত মরিয়া।

রাজ্যের তৃতীয় শক্তি জেডিএসের গুরুত্ব বাড়ে বিজেপি বা কংগ্রেস নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পেলে। ২০১৮ সালের ভোটে ৩৮ আসন জিতে তারা এমনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়েছিল। তারা যে অঞ্চলে শক্তিশালী, সেখানে তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। জেডিএসের ফল ভালো হলে কংগ্রেসের দুশ্চিন্তা বাড়বে। খারাপ হলে বিজেপির।

মোদি–আদানি সম্পর্ক, রাহুলের সংসদ সদস্য পদ খারিজ, ইডি–সিবিআই–আয়কর বিভাগের ‘আতঙ্ক সৃষ্টি’, সার্বিক ‘গণতন্ত্রহীনতা’ ও শাসকের ‘স্বৈরাচারিতা’ জাতীয় স্তরে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তার পরিণতি আগামী দিনে কেমন হতে পারে, সে প্রশ্নের জবাব কর্ণাটক থেকেই আসতে চলেছে। আগ্রহের অবসান ঘটতে বাকি মাত্র দেড় মাস।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি