বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরব কেন

বাংলাদেশের সংবিধান ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো সংবিধান। ৫০ বছর আগে ৪ নভেম্বর এটি গণপরিষদে গৃহীত হয়েছিল। এরপর অসামরিক ও সামরিক—সব শাসনামলে এর সংশোধনী হয়েছে, প্রতিটি আমলের কোনো না কোনো সংশোধনীতে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থকে জনস্বার্থের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে বহুবার বিভিন্ন মহল থেকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো আমলে সেখানে পুরোপুরি ফেরত যাওয়া হয়নি। এমনকি ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সম্পাদিত সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতেও কিছু ক্ষেত্রে সামরিক শাসনামলের বিধান রেখে দেওয়া হয়েছিল (যেমন রাষ্ট্রধর্ম) বা ১৯৭২ সালের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল (যেমন শুধু উচ্চ আদালতের হাতে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা)।

সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি আবারও উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এটি বিবেচনার জন্য এই সংবিধানপ্রণেতাদের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষাকে প্রথমে উপলব্ধি করা প্রয়োজন; প্রয়োজন এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণের সাংবিধানিক পদ্ধতিগুলোর শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করাও। এগুলো কখনো পূর্ণাঙ্গভাবে করা হয়নি।

২.

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে গণপরিষদ গঠন করা হয় (১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিজয়ীদের নিয়ে), এর দুই খণ্ডের কার্যবিবরণী ও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে সংবিধান প্রণয়নের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসব দলিলের সঙ্গে ১৯৭২ সালের সংবিধান মিলিয়ে পড়লে এটি স্পষ্ট যে আমাদের আদি সংবিধানপ্রণেতারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওপর (অন্য দুটি মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা)।

গণপরিষদের সদস্যরা সমাজতন্ত্র বলতে সব ধরনের শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা ও দুর্নীতিহীন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে রাষ্ট্রের একটি প্রধান দায়িত্ব হবে মানুষের মৌলিক চাহিদা বা অর্থনৈতিক অধিকারগুলো (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) পূরণের ব্যবস্থা করা। এ জন্য পদ্ধতি হিসেবে তাঁরা রাষ্ট্রীয় (জনগণের) মালিকানার প্রসার ও রাষ্ট্রের একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করার উপযোগী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদকে প্রদান করেছিলেন এবং নির্বাচিত সরকারকে এই লক্ষ্যে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্ষমতায়িত করেছিলেন।

গণপরিষদের বিশ্বাস ছিল যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্রের পথে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সাচ্চা’ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদীয় সরকারের মাধ্যমে। গণতন্ত্র বলতে তাঁরা শুধু জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনকে নয়, একই সঙ্গে আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বুঝিয়েছিলেন। গণপরিষদের সদস্যরা গর্ব করে ১৯৭২ সালের সংবিধানে কালো আইন জারি ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার সুযোগের অনুপস্থিতির কথাও বলেছিলেন।

চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় না, হতে পারে না। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতা থেকে পদ্ধতি পরিবর্তনের সুযোগ আমাদের রয়েছে। শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি, সরকারের আর্থিক জবাবদিহি বৃদ্ধি ও ৭০ অনুচ্ছেদের আওতা সীমাবদ্ধ করে এবং আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বাস্তবায়নের সুযোগ আমাদের এখনো রয়েছে।

মোটাদাগে বললে, এ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও জনগণকে দেওয়া মৌলিক অধিকারের মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র লারমা ও আওয়ামী লীগের দু-একজন সদস্য মূলনীতি (বিশেষ করে অর্থনৈতিক অধিকারগুলো) আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয় কেন এবং মৌলিক অধিকারের (নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো) ওপর আইন প্রণয়ন করে বাধানিষেধ আরোপের সুযোগ আছে কেন—জোরালোভাবে এসব প্রশ্ন তুলেছিলেন। গণপরিষদে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে ড. কামাল হোসেন বারবার আশ্বস্ত করেছিলেন যে ভবিষ্যৎ সরকারগুলো অবশ্যই মূলনীতি বাস্তবায়ন করবে (এবং এ জন্য আদালতের ভূমিকা পালনের প্রয়োজন নেই) এবং মৌলিক অধিকারবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। কিন্তু এই আশ্বাসবাণী কোনো সরকারের আমলেই রক্ষিত হয়নি।

১৯৭২ সালের সংবিধানের আরেকটি সীমাবদ্ধতা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও জবাবদিহি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। গণপরিষদের সুযোগ ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, খাজা আহমেদ, মানবেন্দ্র লারমাদের প্রস্তাব মোতাবেক অর্থনৈতিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান তৈরি করার। সুযোগ ছিল সংবিধানে ভিন্ন জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি প্রদানের বা রাষ্ট্রের ব্যয় নিয়ে অধিকতর জবাবদিহি সৃষ্টির। এগুলো তখন করা হয়নি।

৩.

গণপরিষদের এসব প্রত্যাশার মধ্যে সম্ভবত কোনো খাদ ছিল না। কিন্তু এ জন্য তাঁরা পদ্ধতি হিসেবে যে সরকারকাঠামো বেছে নেন, তাতে কিছু সমস্যা ছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রধান গলদ ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান। ড. কামাল হোসেনসহ কেউ কেউ গণপরিষদে বলেছিলেন যে অন্য দেশের সংবিধানেও প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা রয়েছে। তবে কথাটি আসলে পুরোপুরি সঠিক ছিল না। আমরা যদি ভারতের সংবিধানই দেখি, সেখানে রাষ্ট্রপতি কাজ করেন মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে। অর্থাৎ সে দেশে প্রধানমন্ত্রী নন, পুরো মন্ত্রিসভা যৌথভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদান করে এবং সে নথিও রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রিসভার কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির এ সুযোগ নেই, তাঁকে চলতে হয় অক্ষরে অক্ষরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে একক ও পরামর্শমূলক ক্ষমতা মিলিয়ে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায়িত করা হয়েছিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এটিকে আইয়ুব খানের সঙ্গে তুলনীয় বলে সমালোচনা করেছিলেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানের অন্য একটি ত্রুটি ছিল সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। গণপরিষদে এর পক্ষে বলতে গিয়ে সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজনের কথা বলা হয়। এর প্রতিকার হিসেবে শুধু অনাস্থা ভোটের সময় দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে না—এ ধরনের বিধান করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে কোনো বিষয়েই সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে না—এই বিধান করে সরকারের (বিশেষ করে সংসদ নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর) স্বেচ্ছাচারিতার বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

১৯৭২ সালের সংবিধানের আরেকটি সীমাবদ্ধতা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও জবাবদিহি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। গণপরিষদের সুযোগ ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, খাজা আহমেদ, মানবেন্দ্র লারমাদের প্রস্তাব মোতাবেক অর্থনৈতিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান তৈরি করার। সুযোগ ছিল সংবিধানে ভিন্ন জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি প্রদানের বা রাষ্ট্রের ব্যয় নিয়ে অধিকতর জবাবদিহি সৃষ্টির। এগুলো তখন করা হয়নি।

১৯৭২ সালের সংবিধানের উপরিউক্ত সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার বা একে উন্নততর করার সুযোগ পরের অনেকগুলো সংসদের ছিল। পৃথিবীর বহু দেশ এমন ধরনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জনকল্যাণকর শাসন, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিটি সংসদ ১৯৭২ সালের সংবিধানের শক্তিশালী বিধানগুলো খর্ব বা বাতিল করেছে এবং এর দুর্বল বিধানগুলো রেখে দিয়েছে।

৪.

সংবিধানের সংস্কার নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমাদের এসব বিষয় উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের গণপরিষদের ‘লক্ষ্য’ ছিল প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা, সেদিক থেকে দেখলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছিল স্রেফ সরকার পরিচালনার ‘পদ্ধতি’। গণপরিষদের ‘লক্ষ্য’ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য আর শোষণের অবসান, ‘পদ্ধতি’ ছিল জাতীয়করণ।

চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় না, হতে পারে না। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতা থেকে পদ্ধতি পরিবর্তনের সুযোগ আমাদের রয়েছে। শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি, সরকারের আর্থিক জবাবদিহি বৃদ্ধি ও ৭০ অনুচ্ছেদের আওতা সীমাবদ্ধ করে এবং আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বাস্তবায়নের সুযোগ আমাদের এখনো রয়েছে।

এসব প্রস্তাব (এবং সমাজে বিভিন্ন সময় উত্থাপিত অন্য দাবিগুলো) বিবেচনায় নিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি বাস্তবায়নের উপযোগী সরকার, সংসদ ও বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা আমাদের ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সংবিধানের লক্ষ্য ও মূলনীতিতে অবশ্যই পুরোপুরিভাবে ফিরব। কিন্তু এসব বাস্তবায়নের উপযোগী পদ্ধতি গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। গণপরিষদ বিতর্ক নিয়ে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে প্রথমা প্রকাশন থেকে