‘ইসরায়েলি গণহত্যার সমালোচনা করলে সেটিাকে ‘সেমেটিক-বিরোধী’ এবং সহিংসতা অথবা সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বলে চিত্রিত করা হচ্ছে।’
‘ইসরায়েলি গণহত্যার সমালোচনা করলে সেটিাকে ‘সেমেটিক-বিরোধী’ এবং সহিংসতা অথবা সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বলে চিত্রিত করা হচ্ছে।’

মতামত

যুক্তরাষ্ট্রে ‘ডাইনি খোঁজার’ মতো আরব ও মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পুরোমাত্রার কূটনৈতিক, অর্থনীতিক ও সামরিক সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল ৮০ দিন ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ২১ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। আইনবিশারদেরা ইসরায়েলের এই আগ্রাসনকে গণহত্যা বলছেন। তাঁরা বলছেন ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় আরও অজস্র যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্য কোনো খানে যে ক্ষোভ জন্ম হচ্ছে সেটাকে বিপজ্জনকভাবে কালিমা লেপন করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে নীরবে বর্ণবাদকে অস্ত্র করে তোলা হচ্ছে।

ইসলামভীতি ও ফিলিস্তিনবাদ বিরোধিতাকে উসকে দেয় এমন কথাবার্তায় প্ররোচিত হয়ে ফিলিস্তিন, আরব ও মুসলিম আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার যেভাবে লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, সেটি এক কথায় অভূতপূর্ব। এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে মারাত্মক সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।

কিন্তু এই দলান্ধ দমনপীড়ন শুধু ফিলিস্তিন, আরব ও মুসলিমদের ওপরেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং এই আক্রমণ আমেরিকার একেবারে গোড়ার নৈতিক ও নাগরিক মূল্যবোধগুলোর (আমেরিকান গণতন্ত্রের ভিতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত) ওপর হুমকি সৃষ্টি করছে।

ইসরায়েলি গণহত্যার সমালোচনা করলে সেটিাকে ‘সেমেটিক-বিরোধী’ এবং সহিংসতা অথবা সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বলে চিত্রিত করা হচ্ছে। এসব কৌশল অবশ্য নতুন নয়; কিন্তু এগুলো এখন এতটাই বিস্তৃত ও ব্যাপক হয়েছে যে সেটি যেন ‘ডাইনি খোঁজার’ মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে।

গত আড়াই মাস ধরে যুদ্ধ বন্ধ, অস্ত্রবিরতি, ফিলিস্তিনিদের সম–অধিকার ও যুদ্ধাপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে বড় প্রতিবাদ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

কিন্তু এসব কর্মসূচিকে ফিলিস্তিনবাদ সমর্থনের আন্দোলন হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চলছে। আবার ইসরায়েলি গণহত্যার সমালোচনা করলে সেটিাকে ‘সেমেটিক-বিরোধী’ এবং সহিংসতা অথবা সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বলে চিত্রিত করা হচ্ছে।

এসব কৌশল অবশ্য নতুন নয়; কিন্তু এগুলো এখন এতটাই বিস্তৃত ও ব্যাপক হয়েছে যে সেটি যেন ‘ডাইনি খোঁজার’ মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনি, আরব, মুসলিম আমেরিকান এবং অন্য যেকোনো পরিচয়ের যারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে পরিচালিত সহিংসতা ও ইসরায়েলের বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের সবাইকেই নিশানা করা হচ্ছে।

অক্টোবর মাস থেকে হাজার হাজার মানুষ এই মনস্তাত্ত্বিক দমনাভিযানের শিকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলনকর্মীদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। তাদের সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। অনুমতি ছাড়াই তাদের তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। বিলবোর্ডে তাদের ছবি ও নাম প্রকাশ করে তাতে মিথ্যা তথ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানহানিকর মন্তব্য করা হয়েছে।

যারা ইসরায়েলি গণহত্যার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের চুপ করিয়ে দিতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে, রাস্তায় ও অনলাইনে হয়রানি করা হচ্ছে। চাকরি বা কাজ হারানোসহ অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়ছে তারা।

এই শাস্তি শুধু অনলাইন পরিসর আর ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতেই সীমাবদ্ধ নেই। আমেরিকার ক্ষমতার সরণিতেও সেটি ছড়িয়ে পড়েছে।

নভেম্বর মাসে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের’ বয়ানে মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো যে, নিবন্ধনকৃত দাতব্য সংস্থাগুলো (আমেরিকান মুসলিমস ফর প্যালেস্টাইন বা এএমপি, আমেরিকানস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন অ্যাকশন বা এজেপি অ্যাকশন ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ গোষ্টীগুলোকে ‘সমর্থন জোগাচ্ছে’।

এই মিথ্যা অভিযোগে দিয়েই তারা থেমে থাকল না, পুরোপুরি অবাস্তব দাবি করে বসল যে এসব সংস্থা ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক’ দিয়েছে।

ইসরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের যেসব সদস্য কথা বলেছেন, শুনানির সময় তাদের নাম উচ্চারণ করে দুয়োধ্বনি দেওয়া হয়।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কুৎসা ও মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক জিনিস; কিন্তু কংগ্রেসে যদি মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়, তবে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা মৌলিকভাবেই কঠিন। কংগ্রেসের শুনানিতে যখন এসব মিথ্যা ও দলকানা দাবি উত্থাপন করা হয়, নিশ্চিতভাবেই তার অর্থ হলো, আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্নমতের অধিকার সুরক্ষায় যে অঙ্গীকার করেছে, তার খেলাপ। আর সেটি ঘটছে এমন এক সময়ে যখন মার্কিন নাগরিকদের করের অর্থ গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার সমর্থনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এসব অবমাননাকর ও দমনমূলক কৌশলের বিপজ্জনক সব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এগুলো ঘৃণা উসকে দেয় এবং জনসাধারণকে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ জোগায়।

নিউইয়র্ক স্টেট হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর শহরটিতে ঘৃণা বক্তব্য বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ।

নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোও গত দুই মাসে ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিমদের ওপর হামলার অসংখ্য অভিযোগের কথা বলছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এ ধরনের হামলার অভিযোগ ২০০ শতাংশ বেড়েছে।

এসব অভিযোগের অনেক ঘটনা শুধু মৌখিক আক্রমণ ও অনলাইনে হয়রানি নয়, পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করার মতো ঘটনাও রয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশু ওয়াদেয়া আল-ফাইউমিকে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। হামলার সময় হামলাকারী বলতে থাকে, ‘তোমরা মুসলিম, অবশ্যই তোমাদের মরতে হবে।’ শিশুটির মাকেও ছুরি মারা হয়, কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত বেঁচে যান।

২৫ নভেম্বর আরবিতে কথা বলা ও কিফায়া পরার জন্য তিনজন ফিলিস্তিনি ছাত্রকে গুলি করা হয়। তাঁরা তিনজনও আহত হন।

ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলো আমাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার যুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, গাজায় ইসরায়েল যে অপরাধ করে চলেছে, তা থেকে জনসাধারণের মনোযোগকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। আমরা মনে করি, সত্যের চেয়ে কুৎসা ও মিথ্যা যখন জয়ী হয়, তখন একটা দেশের অন্তুর্ভুক্তিমূলক ও বর্ণবাদবিরোধী গণতন্ত্রের পথ থেকে ভিন্ন পথে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

  • ওসামা আবু ইরশিদ আমেরিকানস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন অ্যাকশনের নির্বাহী পরিচালক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত