ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের ক্ষমতার কেন্দ্রকে যেভাবে পূর্বে সরিয়ে দিচ্ছে

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অবশেষে ইউক্রেনে ‘লেপার্ড ২’ ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হয়েছেন
ছবি: এএফপি

কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত কূটনৈতিক দর-কষাকষির সময় বিরক্তি প্রকাশের পাশাপাশি কখনো কখনো কথাবার্তায় তালগোল পাকিয়ে ফেলা জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অবশেষে ইউক্রেনে ‘লেপার্ড ২’ ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হয়েছেন। যদিও ট্যাংকের সংখ্যাটা আশাব্যাঞ্জক নয়; সাকল্য জার্মানির ১৪টি ট্যাংক যুক্ত হবে ইউক্রেনের সামরিক বহরে। এরপরও তার এ সিদ্ধান্তে ইউক্রেনে নতুন করে অস্ত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাধা কেটেছে।

ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডস এরই মধ্যে নিজেদের কিছু লেপার্ড ট্যাংক ইউক্রেনকে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পিছিয়ে নেই নরওয়ে, স্পেনও।
লেপার্ড ট্যাংকের এসব চালান শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট বড় হবে, যা দিয়ে রুশ সেনাদের পিছু হটাতে পারবেন ইউক্রেনীয় সেনারা। এর মধ্য দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আপাতত দায়মুক্তি দিয়ে বেসামরিক নাগরিক হত্যা এবং কাঠামোগতভাবে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধে বহুল প্রতীক্ষিত গতি আসবে।

ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা এ ভেবে আশ্বস্ত হয়েছেন যে শলৎজ অবশেষে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও এ সিদ্ধান্তের বাইরে থাকতে সম্ভাব্য সবকিছু করেছেন তিনি।

ইউক্রেনে জার্মান ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্তের খবরটি জানাজানি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আনন্দচিত্তে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ‘সম্পূর্ণ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সর্বতোভাবে ঐক্যবদ্ধ।’

বার্লিন থেকে আসা খবর বলছে, ট্যাংক পাঠাতে দোটানায় থাকা নিয়ে কোনো ধরনের অনুশোচনার বদলে শলৎজ মনে করছেন, তিনি ভালোভাবেই নিজেকে দায়মুক্ত রাখতে পেরেছেন। ব্যাপক বিতর্কিত একটি প্রশ্নে নিজ দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠাতে রাজি করতে পেরেছেন বলেও মনে করেন তিনি।

দুঃখের বিষয় হলো ইতিবাচক এ বক্তব্যের বেশির ভাগই দূরকল্পনা। কারণ, এ চিন্তায় ইউরোপে জার্মানির প্রভাব বলয়ের আকস্মিক পতন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মহাদেশের ব্যাপকতর কৌশলগত পরিবর্তনের বিষয়টি ছিল উপেক্ষিত।

ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক সংশ্লিষ্টতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ল। উচ্চঝুঁকি নিতে ইউক্রেনের পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের একমত হওয়ার কারণ হলো তারা যথার্থভাবে এ উপসংহার আসতে পেরেছেন যে পুতিনের ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধকে অব্যাহত রাখাটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
যুদ্ধ যেদিকেই মোড় নিক না কেন, আসন্ন মাসগুলোয় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সামনে আসা তীব্রতা বাড়ানোর অনেকগুলো পদক্ষেপের একটি হলো ট্যাংক পাঠানো। রাশিয়ার বসন্তকালীন অনিবার্য আক্রমণ ধারণার চেয়ে বেশি সফল হলে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধবিমান সরবরাহের চাহিদা বাড়বে। একইভাবে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষায় ন্যাটোর সরাসরি যুক্ত হওয়ার তাগিদও বাড়বে, বর্তমানে যেটা কল্পনাতীত। নিকট অতীতে ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোর ট্যাংক পাঠানোর আলোচনাটাও নিষিদ্ধ বিষয়ের মতো ছিল।

পক্ষান্তরে ইউক্রেনের অনুমিত আক্রমণ ন্যাটোর সামরিক কৌশলবিদদের ধারণার চেয়ে বেশি সফল হলে রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া মুক্ত করার (যার মধ্য দিয়ে উপদ্বীপ থেকে লাখো রুশ বসতি স্থাপনকারী পালিয়ে যেতে পারেন) প্রশ্নটি আসবে। পরিস্থিতি এমন হলে চরম লজ্জা ও পতন ঠেকাতে পুতিনের নেতৃত্বাধীন সরকারের পরমাণু শক্তি ব্যবহারের ঝুঁকি থাকবে।

মহাদেশের ক্ষমতার কৌশলগত কেন্দ্র সন্দেহাতীতভাবে পশ্চিম দিক (যেখানে জার্মানি ও ফ্রান্স বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত) থেকে সরে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপমুখী হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো সময় বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এবং পোল্যান্ড মিলে জার্মানিকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছে।

অনেক দেরিতে ও চাপে পড়ে শলৎজের কৌশলগত প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা এরই মধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে আসন্ন মাসগুলোয় ন্যাটোর সামনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ট্যাংক পাঠানোর মধ্য দিয়ে যুদ্ধে জার্মানি কতটা জড়িয়ে পড়বে কিংবা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়গুলো নিয়ে নিজস্ব ভাবনা কী, তা সাধারণ জার্মানদের কাছে ব্যাখ্যা করতে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেননি চ্যান্সেলর। স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে বিভক্ত জার্মানির জনগণ, যেটাকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রুশ বংশোদ্ভূত জার্মান লেখক ভ্লাদিমির কামিনের। তাঁর ভাষ্য, জার্মানির অর্ধেক জনগণ ট্যাংকের ওপর বসে আছেন, যেখানে বাকি অর্ধেক সেখান থেকে লাফিয়ে পড়তে চাইছেন।

যে বিষয়ে জার্মানরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা হলো নেতৃত্বের গুণাবলির ঘাটতি রয়েছে শলৎজের। সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুযায়ী, ভোটারদের মাত্র এক–চতুর্থাংশ তাঁকে বলিষ্ঠ নেতা মনে করেন। পরিবর্তনের অনুঘটক হওয়া তো দূরের কথা, জার্মানির ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্তে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে ভবিষ্যতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পদশালী দেশ প্রয়োজনীয় দ্রুতগতি কিংবা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখাতে পারবে। ইউক্রেনে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ফলে ইউরোপে যেসব মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, সেগুলোর সঙ্গে জার্মানিকে কতটা মানিয়ে নিতে হবে, তা নিয়ে বার্লিনে যথেষ্ট আন্তরিক কোনো বোঝাপড়াও নেই।

মহাদেশের ক্ষমতার কৌশলগত কেন্দ্র সন্দেহাতীতভাবে পশ্চিম দিক (যেখানে জার্মানি ও ফ্রান্স বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত) থেকে সরে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপমুখী হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো সময় বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এবং পোল্যান্ড মিলে জার্মানিকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছে। ওই দেশগুলো নৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করেছে এ কারণে যে তাদের মধ্যে সাম্রাজ্যমুখী রাশিয়ার বিপজ্জনক হয়ে ওঠা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। একই সঙ্গে দেশগুলো ইউরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সরাসরি ও বাস্তবভিত্তিক প্রভাব রেখেছে।

  • দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
    ইংরেজি থেকে অনূদিত
    জোনাথন ইয়েল রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের কৌশলগত গবেষণা অংশীদারত্ব বিষয়ক সহযোগী পরিচালক।