পুতিন এখন পশ্চিমাদের মনোবল ভেঙে দিতে মরিয়া

ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি : এএফপি

ইউক্রেন নামের জাহাজটি তার পালে উন্মাতাল হাওয়া নিয়ে ২০২৩ সালে প্রবেশ করছে। সব প্রতিকূলতার মুখে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার কিয়েভ দখলের প্রাথমিক চেষ্টাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

তারপর তারা রাশিয়ার দখল করে নেওয়া খারকিভ, খেরসনসহ আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছে এবং হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। পলিটিকো পত্রিকা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করার ঠিক পরই তিনি শীত মৌসুমে একটি আশাবাহী বক্তব্য শুনিয়েছেন।

তিনি কিছুটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করে বলেছেন, ইউক্রেনীয়রা আসছে বছরের মধ্যে ‘শান্তিকাল’ উপভোগ করবে। তবে সত্যিই শান্তি আসবে কি না, তা বলা কঠিন। যেমনটা পোল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদেক সিকোরস্কি বলেছেন, শান্তির জন্য একটি সমঝোতার কল্পনা করা এখনো কঠিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি ইউক্রেনকে ‘জোটনিরপেক্ষ’ রাখতে চান, তাহলে তাঁকে কার্যকরভাবে নাকে খত দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে ইউক্রেনের গোটা ভূখণ্ড থেকে সরে আসতে হবে।

একইভাবে জেলেনস্কিও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ না দেওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনের এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন না। এ পরিস্থিতিতে যে যা-ই বলুন, সেখানে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের স্পষ্ট পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে।

রাশিয়ার সামরিক জয়ের সম্ভাবনা কমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পুতিন ইউক্রেন দখল থেকে মনোযোগ সরিয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন ও মদদ দেওয়া পশ্চিমা জোটের ঐক্য ভাঙার দিকে মনোনিবেশ করছেন। এভাবে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এমন একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন, যা যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনে রাশিয়া যেসব সন্ত্রাসী কৌশল নিয়েছে, তার একটি হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলা। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেনীয়দের জীবনকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বিষহ করে তোলা এবং একপর্যায়ে তাদের দেশ ছেড়ে ইইউর দেশগুলোতে দলে দলে শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়া নিশ্চিত করতে রাশিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনীয়দের ৩০ শতাংশ লোক বেকার হয়ে পড়েছেন এবং জেলেনস্কি বিদেশে থাকা শরণার্থীদের এ শীতে দেশে না ফিরতে অনুরোধ করেছেন।

পুতিনের এসব চক্রান্তের লক্ষ্য যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। পুতিন বিশ্বাস করেন, তাঁর জয়ের একমাত্র পথ হলো পশ্চিমকে বিভক্ত করে ফেলা। বিশেষ করে ইউক্রেনকে সমর্থন জোগাতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তা কত দিন সহ্য করা ঠিক হবে, তা নিয়ে ইউরোপের মধ্যে মতভেদ তৈরি হচ্ছে। পুতিন সেই মতভেদকে ইউরোপকে বিভক্ত করার কাজে ব্যবহার করতে চান। এ কারণে এ যুদ্ধ শিগগির থামবে, এমনটা ধারণা করা কঠিন।

এ বছর ইউক্রেনের ১ কোটি ৪০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে এতসংখ্যক লোক বাস্তুচ্যুত হয়নি। ২০১৫ সালে ৮০ লাখ শরণার্থী ইউরোপে এসে ইতিমধ্যেই ইউক্রেনীয়দের দলে দলে চলে আসার ‘ওয়ার্মআপের’ কাজ সেরে রেখেছে। এখন যে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা আসছে, তাদের প্রতি ইউরোপীয়দের উদারতা যথেষ্ট হৃদয়গ্রাহী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা কি স্থায়ী হবে?

পোল্যান্ডের মতো দেশে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পোল্যান্ডের মোট বাসিন্দার ৮ শতাংশের বেশি বাসিন্দার জন্ম পোলিশ ভূখণ্ডের বাইরে এবং সে কারণে কিছু ভাষ্যকার এখন পোল্যান্ডকে একটি ‘দ্বিজাতিক দেশ’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। পোল্যান্ডের এই রূপান্তরের পরিণতি হবে অনেক গভীর। পোল্যান্ড ইতিমধ্যে ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সহায়তা হিসেবে শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যয়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যয় করেছে। পোল্যান্ড একা নয়, জার্মানিও ১০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয়কে গ্রহণ করেছে।

এ অভিবাসনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পুতিন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। অভিবাসীদের ঢল যাতে ইউরোপের দেশগুলোতে আছড়ে পড়ে এবং সেই চাপে পড়ে পশ্চিমাদের সংকল্প যাতে দুর্বল হয়ে পড়ে, সে জন্য পুতিন ইউক্রেনে জ্বালানি, খাদ্য ও সার সরবরাহে বাধা দেওয়া অব্যাহত রাখবেন। দ্য ইকোনমিস্ট-এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, পুতিনের জ্বালানিযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যবৃদ্ধি এ শীতে ইউরোপজুড়ে এক লাখের বেশি অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ হতে পারে, যা সম্ভবত এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে বেশি।

পুতিন তাঁর জ্বালানিযুদ্ধের প্রভাবকে আরও গভীর করতে নাশকতা ও সাইবার হামলা চালিয়ে যাবেন। পাইপলাইন, সাবমেরিন কেব্‌ল, রেলপথ ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করতে চেষ্টা করবেন। এ ছাড়া তিনি পশ্চিম বলকান, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেষ্টা চালাবেন।

পুতিনের এসব চক্রান্তের লক্ষ্য যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। পুতিন বিশ্বাস করেন, তাঁর জয়ের একমাত্র পথ হলো পশ্চিমকে বিভক্ত করে ফেলা। বিশেষ করে ইউক্রেনকে সমর্থন জোগাতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তা কত দিন সহ্য করা ঠিক হবে, তা নিয়ে ইউরোপের মধ্যে মতভেদ তৈরি হচ্ছে। পুতিন সেই মতভেদকে ইউরোপকে বিভক্ত করার কাজে ব্যবহার করতে চান। এ কারণে এ যুদ্ধ শিগগির থামবে, এমনটা ধারণা করা কঠিন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • মার্ক লিওনার্ড ব্রিটিশ রাজনীতিবিজ্ঞানী ও লেখক এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক