আওয়ামী লীগের মন খারাপ

সাফল্যের অনেক ভাগীদার থাকেন। ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চান না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কেন নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকলেন না?

প্রথম কথা হলো, তাঁদের কি মাঠে থাকার কথা ছিল? সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও কি ‘এইড  টু সিভিল প্রশাসন’ হিসেবে কাজ করবেন, এটা আশা করেছিলেন?

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকা না রাখার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ১০৮টি ইউনিট কমিটির মধ্যে ২৭টি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

ইউনিট কমিটির ওপর উপজেলা কমিটি আছে। তাদের তদারক করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর মহানগর কমিটি আছে। তারও ওপর কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। ‘ব্যর্থতার জন্য’ যদি কমিটি ভেঙেই দেওয়া হয়, ওপর থেকেই তা শুরু করা উচিত।

শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গত চার দিন মূল্যায়ন সভা করেছেন তাঁরা। তাঁরা কিসের মূল্যায়ন সভা করেছেন, সেটাও জানা জরুরি।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, কোটা সংস্কার  আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা-নাশকতা হলো সে জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী। শিক্ষার্থীরা সহিংসতা করেননি। তাহলে শিক্ষার্থীদের দলে দলে হাতকড়া পরিয়ে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে কেন?

গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগের মধ্যম পর্যায়ের যেসব নেতা, সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে দেখা হলো, তাঁদের চেহারাও বিষণ্ন দেখলাম। মনে হল, তাঁদের মন খারাপ।

কয়েক দিন আগেও দলীয় কার্যালয়ে যে জমজমাট ভিড় ছিল, তা এখন ম্রিয়মান। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ দলীয় কার্যালয়ে যান না। সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হলে এমনকি ফোনেও তাঁদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেন—ভাই, কী হচ্ছে?

যে দলটি বিডিআর ট্র্যাজেডি, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারল, সেই দলটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এভাবে খাদে পড়ল কেন? কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, দলের কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতার দায়িত্বহীন মন্তব্যের কারণে এমনটি হয়েছে।

কিন্তু ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের কাছাকাছি বয়সের নেতারা শুরু থেকে যে বিষয়টি আমলে নেননি, সেটি হলো সাধারণ মানুষ থেকে দলের বিচ্ছিন্ন হওয়া। আওয়ামী লীগের কাজ রাজপথে বিরোধী দল বা শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ভন্ডুল করে দেওয়া নয়। নেতারা সরকারের নীতি পরিকল্পনাগুলো জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেটা তদারক করতে পারে।

আওয়ামী লীগের দাবি, নিরীহ ও নির্দোষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি  করেছে। তাঁরা যদি জানতেনই, বিএনপি-জামায়াত এ রকম কাণ্ড ঘটাবে, তাহলে আগে ভাগে সমস্যার সমাধান করলেন না কেন?

আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে না, এ রকম কোনো বিধান নেই। শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, এটা আদালতের বিষয় নয়। নির্বাহী বিভাগের কাছেই তারা সমাধান চান। শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো।

আওয়ামী লীগ নেতারা একদিকে বললেন, শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে তাঁরা একমত, অন্যদিকে  তাঁদের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে হুংকার ছাড়লেন। ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলেন। তারা তরুণদের শক্তি ও সাহসকে আমলে নিলেন না। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, ৭ জানুয়ারির আগে বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনকে যেভাবে ঠান্ডা করা হয়েছে, সেভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেও সেভাবে ঠান্ডা করা যাবে। এখানেই তারা বড় ভুল করলেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের মাঠে মোকাবিলা করতে না পারার ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে এখন হিসেব নিকেশ করছেন। কিন্তু যদি তারা ব্যর্থ না হতেন তাহলে চিত্রটি কেমন হতো। আরও সংঘাত, আরও সংঘর্ষ। অরও প্রাণহানি। আরও নৈরাজ্য। সেটা কি কারও কাম্য হতে পারে?

রাজপথে সহিংসতা হলে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সেটা দেখার দায়িত্ব  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু সেখানে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো কাজ থাকতে পারে না। ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কার আন্দোলন ও  নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও যে ‘হেলমেট বাহিনী’ নামানো  হয়েছিল, তার ফল সরকারের জন্য ভালো হয়নি।

কোটা সংস্কার নিয়ে আওয়ামী লীগের নিজস্ব হিসেব নিকেশ থাকতে পারে। তারা তাদের যুক্তি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে যদি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে হয় তাহলে সরকারের প্রয়োজন কী। এবারও আমরা অস্ত্রধারী হেলমেট পরিহিতদের রাস্তায় দেখেছি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করতে।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমস্যা হলো তারা সরকার ও দলের পার্থক্য বোঝেন না। আজ আওয়ামী লীগের যে অবস্থায় এসেছে, সেটা ২০০৯-২০১০ সালে কেউ ভাবতেও পারেননি। দলের নেতারা বুঝতে অক্ষম যে পর পর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ছলে বলে ক্ষমতা ধরে রাখা গেলেও মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করা যায় না।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ভূমিধস বিজয় লাভ করল, তার পেছনে ছিল বিএনপির সরকারের আমলের (২০০১-২০০৬) দুর্নীতি, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা।

এসব কারণে আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদের প্রতি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আস্থা রেখেছিল। কিন্তু ১৫ বছর পর মানুষ দেখল, জঙ্গিবাদের উত্থান ছাড়া বাকি সব উপসর্গই উৎকটভাবে দৃশ্যমান। দুর্নীতি উচ্ছেদের কথা বলে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। বেনজীর ও মতিউর কাণ্ড এখন দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমের আকর্ষণীয় বিষয় হয়েছে।

আওয়ামী লীগ বিএনপির আমলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কৃতিত্ব দাবি করে। কিন্তু এই সরকারের আমলে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তরুণদের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সেই তরুণ প্রজন্মকেও প্রতিপক্ষ করে ফেলেছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর—যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্ট বেটাই চোর।” আওয়ামী লীগের নেতারাও দেশে যা কিছু অঘটন ও আন্দোলন সবটার দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রথম দিকে এটা কাজে লাগলেও এখন পালে হাওয়া পাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ নেতারা একদিকে বললেন, শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে তাঁরা একমত, অন্যদিকে  তাঁদের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে হুংকার ছাড়লেন। ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলেন। তারা তরুণদের শক্তি ও সাহসকে আমলে নিলেন না। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, ৭ জানুয়ারির আগে বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনকে যেভাবে ঠান্ডা করা হয়েছে, সেভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেও সেভাবে ঠান্ডা করা যাবে। এখানেই তারা বড় ভুল করলেন।

দেশে এখন লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। প্রতি বছর ২০-২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাদের খুব কমই কাজ পান। শিক্ষার্থীদের ধারণা, কাজের যেটুকু সুযোগ আছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তা বাগিয়ে নেন।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় ছাত্রলীগের অনুকম্পা নিয়ে। ছাত্রলীগ চাইলে সিট পাবেন, না চাইলে পাবেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারে সীমিত ছিল না, ছিল শিক্ষাঙ্গনে প্রশাসনের অবিচার ও ছাত্রলীগের নির্যাতন ও হয়রানির বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ বিষয়গুলো কবে বুঝতে পারবে ক্ষমতাসীন দল?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি