অভিমত

বিএনপি করা কি বেআইনি কাজ

বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বেশির ভাগই জেলে। বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই আত্মগোপনে।
ছবি: প্রথম আলো

কিছুদিন আগে বিএনপির এক কর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান আন্দোলনের দিনলিপি লিখেছেন। দিবাগত রাত তিনটার মধ্যেই ঘুম থেকে ওঠেন। এর হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। অন্ধকারেই নানা অলিগলি পেরিয়ে নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন। রাতের বেলায় ঘর থেকে বের হতে হয়। কারণ, দিনের বেলায় চলাফেরা করা মুশকিল।

গলির মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেঞ্চ পেতে বসে থাকেন। এলাকায় রীতিমতো পাহারা বসান। এর সঙ্গে পুলিশ, র‍্যাব আর গোয়েন্দারা তো আছেই। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্দোলন করা, কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাতেই বেরিয়ে দিনভর চলে চোর-পুলিশ খেলার মতো কর্মসূচি পালন।

কোথাও দুদণ্ড দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। দিনভর খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মিছিল শুরু করলেই পুলিশ এসে আটক করে নিয়ে যায়। আর পুলিশের পিছু পিছু আসেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা কঠিন একসময় অতিক্রম করছেন। অনেকটা ঘরবাড়িছাড়া উদ্বাস্তুর মতো জীবন তাঁদের। আজকে এখানে তো কাল সেখানে রাত কাটছে। কেউ কেউ কারও ঘরেও ঘুমাতে পারছেন না।

বিএনপির কর্মীদের মশারি টানিয়ে ধানখেতে ঘুমানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই এ ছবি দেখেছি।

শুধু ধানখেতই নয়; সুপারির বাগান, ফলের বাগান, রান্নাঘরের লাকড়ি রাখার মাচায়ও রাত অতিবাহিত করছেন। সদা এই আতঙ্ক নিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাঁদের যে কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েও রক্ষা নেই। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই পুলিশ এসে বাড়িঘর তছনছ করে ফেলছে।

অনেক সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা পুলিশকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি চিনিয়ে দিচ্ছে। রীতিমতো পুলিশের সঙ্গে গিয়ে হাত তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে কে কে বিএনপি করেন। নেতা-কর্মীদের না পেয়ে তাঁদের ছেলেসন্তান, ভাই-বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

কাঙ্ক্ষিত নেতা-কর্মী পুলিশের হাতে ধরা দিলেই নিরীহ আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে দিচ্ছে। তবে এমনি এমনি ছেড়ে দিচ্ছে না। এর আগে অবশ্যই আর্থিক লেনদেনের একটি বিষয় থাকছে। অনেকেই অর্থ দিয়ে রফা করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাড়ি চিনিয়ে দেওয়ার ছাড়াও ধরে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের পুলিশের কাছে তুলে দেওয়ার কাজটি করছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে হাতকড়া এল কোত্থেকে?

তাঁরা কি কাউকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের কাছে তুলে দিতে পারেন? আওয়ামী লীগই কি রাজনৈতিক দল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে? তারা কি এখন লোকজনকে আটক শুরু করেছে? বিএনপি করা বা আওয়ামী লীগ না করা কি বেআইনি কোনো বিষয়?

ফলে দেখাই যাচ্ছে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাঁড়াশি অভিযানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘরছাড়া হয়ে রীতিমতো এক সংগ্রামী জীবন যাপন করছেন; যদিও অনেকেই মনে করেন ও বলে থাকেন, কর্মসূচি আহ্বান করে বিএনপির নেতারা বাড়িতে বসে গরম সালুন দিয়ে ভাত খেয়ে আন্দোলন করছেন।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাঁদের অনেকে এখন দুই বেলা ঠিকমতো খেতেও পান না।

ভাসমান অবস্থায় থাকার জন্য আর্থিক জোগান থাকতে হয়। কিন্তু তাঁদের অনেকের পকেটই এখন ফাঁকা।

উত্তরবঙ্গের এক জেলা শহরের ছাত্রদলের কয়েক নেতা গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন। সংগত কারণেই শহরের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হলো না। তাঁদের শহরের বাড়িঘরে থাকার উপায় নেই। দিনভর গোয়েন্দারা বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করেন। তাই তাঁরা বাধ্য হয়েই গ্রামে আত্মীয়র বাড়ি চলে গিয়েছেন। কিন্তু এই গৃহস্থ আত্মীয়ের পক্ষে কয়েকজনের খাবার সরবরাহ করা কঠিন।

শেষ পর্যন্ত মাকে ফোন করে ওই নেতা বলেছেন, বিকাশ করে টাকা পাঠাও, না হলে খাবার কিনে খেতে পারছি না।

বিএনপিকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলা হয়। এর মধ্যে অন্যতম বড় অভিযোগ, দলটির সাংগঠনিক শক্তি নেই তেমন। কিন্তু চলমান আন্দোলন এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। তেমন কোনো সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত ক্যাডারভিত্তিক দল না হয়েও তৃণমূলের ওপর ভর করে বেশ শক্তভাবেই আন্দোলনের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি।

এ-ই হচ্ছে বিএনপির সাধারণ কর্মীদের অবস্থা। হিমালয়সম চাপ তাঁদের ওপর এখন। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বেশির ভাগই জেলে। বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই আত্মগোপনে। এ অবস্থায় সাধারণ কর্মীদের পক্ষে আন্দোলন কর্মসূচিকে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই চাপ ও নানা প্রলোভনকে মোকাবিলা করে মাঠেই অবস্থান করছেন তাঁরা।

বিএনপিকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলা হয়। এর মধ্যে অন্যতম বড় অভিযোগ, দলটির সাংগঠনিক শক্তি নেই তেমন। কিন্তু চলমান আন্দোলন এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। তেমন কোনো সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত ক্যাডারভিত্তিক দল না হয়েও তৃণমূলের ওপর ভর করে বেশ শক্তভাবেই আন্দোলনের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি।

বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। শ্রেণি-চরিত্র হিসাবে বিএনপি একটি বুর্জোয়াদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। তবে চরম পুঁজিবাদী দল নয়; বরং বিএনপির গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজি বিকাশের মধ্যবাম ধারার উদার রাজনীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়।

যদিও বিএনপি পুরোপুরি এই ধারার রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। তবে চলমান আন্দোলনে বিএনপি একধরনের বিপ্লবী স্তরে প্রবেশ করেছে।

বিপ্লব নিয়ে তত্ত্বীয় কথাবার্তা বিএনপির রাজনীতিতে একদমই বলা হয়নি। তবে সম্ভবত দেশের শাসকদের মধ্যে বিপ্লব সংগঠিত করার কথা সবচেয়ে বেশিবার বলেছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিনি এ কথা বলেছেন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। তিনি বলেছিলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের কথা।

এবার চলমান আন্দোলনে বলা যায়, বিএনপি একধরনের রাজনৈতিক বৈপ্লবিক স্তরে প্রবেশ করেছে। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি অন্তত তা-ই বলে।

অনেকেই বলতে পারেন, বুর্জোয়া দলের পক্ষে কীভাবে বিপ্লব সম্ভব। বিএনপি কিন্তু কোনো বিপ্লবের ডাকও দেয়নি। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের কথা বলছে। এক হিসেবে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করছে।

পরবর্তী সময়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনও আনার কথা বলছে না। কিন্তু অবচেতনভাবেই বিএনপি এখন এক বৈপ্লবিক অবস্থার মধ্যে আছে। রাজনীতির গতিবিধিই বিএনপি এখানে নিয়ে এসেছে।

বিএনপি সফল হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি যদি সফল হয়, তবে দল থেকে সংগঠনে পরিণত হবে। যখন সবাই বলাবলি করছিল, দমন-নিপীড়নের মুখে বিএনপি আর দাঁড়াতে পারবে না, তখনই তৃণমূল দলটির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।

এখনো যদি নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেওয়া হয়, তবে কয়েক লাখ মানুষের জনসমাগম নিয়ে সমাবেশ করতে পারবে দলটি। আর এর পুরো কৃতিত্ব তৃণমূলের।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক