ফিলিস্তিনের যেকোনো বড় অভ্যুত্থানে কয়েক দশক ধরে একটি নাম জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে—মারওয়ান বারগুতি (৬৪)। হত্যাসহ একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত বারগুতি ২০ বছর ধরে ইসরায়েলের কারাগারে আটক। অথচ ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস, একমাত্র তিনিই প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ফিলিস্তিনকে এই অচলাবস্থা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম। তিনিই পারেন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা এনে দিতে।
আপনি ফিলিস্তিনের পথে পথে, ইসরায়েলের তৈরি কংক্রিটের দেয়ালে বারগুতির গ্রাফিতি দেখতে পাবেন। হাতকড়া পরা হাতটি মাথার ওপর তুলে ধরে আছেন মারওয়ান বারগুতি। অথচ কী আশ্চর্য! দুই দশকের কারাজীবন তাঁর চোখের জ্যোতি কিংবা বুকের বল—কোনোটিই কেড়ে নিতে পারেনি।
কত দফা যে বারগুতি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই কারাবরণ তাঁকে তাঁর মানুষদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারেনি। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোর প্রতিটিতে তিনি এগিয়ে আছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতা মাহমুদ আব্বাসের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন ৪০ পয়েন্ট। এমনকি কট্টরপন্থী হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েকেও তিনি পেছনে ফেলেছেন।
হামাস বলুন, কিংবা ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা, সবাই একমত, ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দিতে পারেন একমাত্র বারগুতিই।
কিন্তু মারওয়ান বারগুতি কি মুক্তি পাবেন? সম্ভবত খুব শিগগির তাঁর মুক্তির কোনো আশা নেই। বারগুতি মুক্তি পেলে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের যে আলোচনা, তাতে তাকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। অনেকেই মনে করেন, যেকোনো উপায়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁকে অন্তরীণ রাখবেন।
খবর বেরিয়েছে, নেতানিয়াহুর সরকার শুধু মারওয়ান বারগুতিকে আটকে রাখেনি, ৭ অক্টোবরের পর অবর্ণনীয় অত্যাচারও চালিয়েছে।
মারওয়ান বারগুতির ছেলে আরব তাঁর বাবার ওপর ঘটা সাম্প্রতিক নির্যাতন সম্পর্কে বলেন, ‘১৮ মার্চ আমরা এক আইনজীবীর কাছে খবর পাই, একজন কারাবন্দী তাঁকে দেখেছেন। বাবার মুখমণ্ডল রক্তে ভরে ছিল। এক চোখ ছিল লাল। পাঁচ মাস ধরে তাঁর ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাঁকে রাখা হয়েছে একটি প্রকোষ্ঠে।’
মারওয়ান বারগুতির ছেলে আরও বলেন, দিনরাত তাঁর বাবার কানের কাছে উচ্চ শব্দে ইসরায়েলের জাতীয় সংগীত ও ইসরায়েলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছেড়ে রেখেছেন কারারক্ষীরা। চিকিৎসাসেবা ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো সুযোগ তিনি পাননি। যে প্রকোষ্ঠে তাঁকে রাখা হয়, সেখানে বিদ্যুৎ নেই। তাঁর ওজন ১০ কেজি কমে গেছে।
৭ অক্টোবর বেসামরিক মানুষের ওপর হামলাকে অভিনন্দন জানিয়ে বারগুতি কোনো চিঠি লেখেননি বলে দাবি করেছেন বারগুতি ও তাঁর স্ত্রী আইনজীবী ফাদওয়া বারগুতি। পশ্চিমাদের চাপে শেষ পর্যন্ত বারগুতি আইনজীবী পেয়েছেন। ইসরায়েলের একজন শীর্ষ মানবাধিকার আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে অভিযোগ জানালে আবারও তাঁকে ইসরায়েলের কেন্দ্রে রিমোনিম কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
বারগুতির ওপর নির্যাতন চালিয়ে ইসরায়েল এ বার্তা দিতে চায় যে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে।
এ মুহূর্তে ইসরায়েলের মিত্র ও আরব প্রতিবেশীরা যুদ্ধোত্তর গাজার শাসন নিয়ে আলোচনা করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এর নেতৃত্বের প্রসঙ্গটিও উঠছে জোরেশোরে। এমন অভূতপূর্ব, ধ্বংসাত্মক ও প্রাণক্ষয়ী যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দিতে আরেকজন ইয়াসির আরাফাত প্রয়োজন। লন্ডভন্ড হওয়া গাজায় আর যে-ই নেতৃত্বে আসুন, ৮৮ বছর বয়সী অত্যন্ত অজনপ্রিয় নেতা মাহমুদ আব্বাসকে মেনে নিতে কেউই প্রস্তুত নন।
গার্ডিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সাবেক উচ্চপদস্থ ইসরায়েলি নৌ কমান্ডার, শিন বেত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্য আমি আয়ালন বলেন, ‘মারওয়ান বারগুতিই সেই লোক। আপনি ফিলিস্তিনে ভোটের ফল দেখুন। তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি ইসরায়েলের প্রতিবেশী হিসেবে ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। প্রথমত, তিনি দুই রাষ্ট্র ধারণায় বিশ্বাসী এবং দ্বিতীয়ত, তিনি আমাদের জেলে বসেও জনগণের কাছে বৈধতা পেয়েছেন।’
কট্টরপন্থী হামাস, যাদের সঙ্গে ফাতাহর ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, তারাও কেন বারগুতির মুক্তি চাইছে, সে বিষয় পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হয়, ইসমাইল হানিয়েসহ হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারণা করছে, ভয়ংকর এই যুদ্ধের পর মারওয়ান বারগুতির মুক্তি ফিলিস্তিনিদের কাছে কিছুটা হলেও তাদের মুখ রক্ষা করবে।
মারওয়ান বারগুতি কে? কেনইবা তিনি গুরুত্বপূর্ণ?
অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ১৯৫৯ সালে মারওয়ান বারগুতির জন্ম। পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন যখন শুরু হয়, তখন তাঁর বয়স ৮। ১৫ বছর বয়সে তিনি ফাতাহ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ওই বছরই সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ততার অভিযোগে ইসরায়েলিরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
কারণ, বহুধাবিভক্ত ফিলিস্তিনে বারগুতি একজন মধ্যপন্থী নেতা। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী কিংবা ইসলামপন্থী—দুদলের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্বের সূত্রপাত কারাগারে। পশ্চিমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বে নাখোশ হামাসও বারগুতির মুক্তি চায়। এ কথা বলার কারণ, পশ্চিমাদের মধ্যেও বারগুতির বন্ধু আছেন।
১৯৭৮ সালে ১৮ বছর বয়সে ইসরায়েলি কারাগারে তাঁকে অকথ্য নির্যাতন ও জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল। কারাব্যবস্থা সম্পর্কে বারগুতি পরে বলেছিলেন, ইসরায়েল একটা বেআইনি ব্যবস্থা জারি করে যথেচ্ছাচার করছে। ২০১৭ সালে কারাগারে তিনি অনশন আন্দোলন শুরু করেন, ওই সময়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে তিনি তাঁর জেলজীবনের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন।
বারগুতি লেখেন, বহু বছরের অভিজ্ঞতাবলে ইসরায়েল এই বর্বর উপনিবেশবাদী ও সামরিক আগ্রাসন জারি রেখেছে কারাবন্দীদের মনোবলকে গুঁড়িয়ে দিতে। পলে পলে বুঝিয়ে দেয় আমরা ওদের দাস। এই দাসত্বের, শৃঙ্খলের জীবনকে মেনে নিতে ওরা ফিলিস্তিনিদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালায়, পরিবার ও সমাজ থেকে তাদের আলাদা করে ফেলে। এই নির্যাতন, এই দুর্ব্যবহারের পরও আমরা আত্মসমর্পণ করিনি।
দখলদার ইসরায়েল ৭০ বছর ধরে নানাভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে। তারপরও তারা বিচারের ঊর্ধ্বে। ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে, বন্দীদের সঙ্গে যেখানে পুরুষ, নারী ও শিশুরা রয়েছে, তাদের সঙ্গে ওরা যা করছে, তা জেনেভা কনভেনশনের ভয়ংকর ব্যত্যয়।
...যখন সবে ১৮ বছর বয়স, ইসরায়েলি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য আমাকে উলঙ্গ করে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়াতে বাধ্য করে। এরপর আমার প্রজনন অঙ্গে তীব্র আঘাত করে। আমি যন্ত্রণায় নিচে পড়ে যাই। আমার কপাল কেটে যায়। সেই আঘাতের চিহ্ন এখনো আছে।
এরপর ওই লোকটা আমাকে উপহাস করে বলে, আমি কখনো সন্তানের বাবা হতে পারব না। কারণ, আমার মতো মানুষেরা কেবল সন্ত্রাসী আর খুনিদেরই জন্ম দেয়।
কয়েক বছর পর আবার গ্রেপ্তার হলাম। আমার প্রথম সন্তান তখন কেবল জন্মেছে। সন্তানের জন্ম হলে আমরা মিষ্টিমুখ করাই, এর বদলে আমি বন্দীদের মধ্যে লবণ বিলালাম। ওর বয়স যখন ১৮, তখন সে-ও গ্রেপ্তার হলো। তাকেও কারাগারে থাকতে হলো চার বছর।
আমার চার সন্তানের মধ্যে বড়টির বয়স এখন ৩১। এখনো হাজারো কারাবন্দী নিয়ে আমার সংগ্রাম চলছে। আমাদের সঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি আছেন, সারা পৃথিবী থেকে সমর্থন পাচ্ছি আমরা। দখলদার, নির্যাতনকারী এবং তাদের সমর্থকেরা এত অহংকারী যে তারা খুব সাধারণ সত্য কথাও শুনতে পায় না। আমরা শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসব। কারণ, মানুষের চিরন্তন স্বভাবই হলো স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দেওয়া। সে জন্য যে মূল্যই চুকাতে হোক না কেন, সে পরোয়া করে না।’
সীমাহীন নির্যাতনের পরও বারগুতি কারাগারে বসেই লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। জেলে বসেই তিনিই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছিলেন। ইংরেজি ও হিব্রু ভাষাটাও রপ্ত করে নেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি পশ্চিম তীরের বিরযিট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে বারগুতির সময় লেগে যায় ১১ বছর। কিন্তু তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। ছিলেন ফাতাহর ইয়ং গার্ডের সদস্য।
ইয়াসির আরফাত ও মাহমুদ আব্বাস যখন লেবানন ও তিউনিসিয়ায় নির্বাসিত হন, তখন জনসমক্ষে আসেন বারগুতি। পশ্চিম তীরের প্রথম ‘ইন্তিফাদা’য় বারগুতি আবির্ভূত হলেন অন্যতম নেতা হিসেবে।
১৯৮৭ সালে বারগুতিকে গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলিরা জর্ডানে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় ৭ বছর পর অসলো চুক্তির আওতায় বারগুতি ফিলিস্তিনে ফেরেন। এসেই ফিলিস্তিন লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসেন।
সার্জ স্মেম্যান ১৯৯৬ সালে যখন জেরুজালেমে টাইমসের ব্যুরো চিফ ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে প্রথম বারগুতির পরিচয় হয়। অসলো শান্তিচুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনের কিছু অংশে তখন স্বশাসন চালু করেছে। শক্তপোক্ত গড়নের, হাসিখুশি ও আবেগপ্রবণ ৩৭ বছর বয়সী বারগুতির মুখে হাসি লেগেই থাকত। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। দলবল নিয়ে চলতেন। প্রায়ই দেখা যেত দলের লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন, কৌশল ঠিক করছেন।
দ্য টাইমস বারগুতিকে তরুণ, আকর্ষণীয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছিল। আরও বলেছিল, বারগুতিই আরাফাতের উত্তরসূরি। তবে আরাফাত ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে বারগুতির একটি সুস্পষ্ট পার্থক্যও ছিল। আরাফাত দেশান্তরি হয়েছিলেন, সেখান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
অন্যদিকে বারগুতি পশ্চিম তীর ও গাজাতেই বেড়ে উঠেছেন। নিজেকে তিনি ফিলিস্তিনি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক তরুণ বলে পরিচয় দিতেন। অধিকৃত এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার বেদনা তিনি ভালোভাবে জানতেন। সর্বত্র দেখা যেত তাঁকে। শেষকৃত্য, শোকসভা থেকে শুরু করে প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত সর্বত্র।
আবার ইসরায়েল সম্পর্কেও মারওয়ান বারগুতির ভালো ধারণা আছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যে চর্চা, নানা বিষয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্কের সুযোগ সেটি পছন্দ ছিল বারগুতির। তিনি ও তাঁর মতো নবীন রাজনীতিকেরা সে সময় তাঁদের সরকারের ভেতরেও এই প্রথা চালুর পক্ষে ছিলেন।
একপর্যায়ে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গেও অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনীতিকেরা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। একটি অধিবেশনে নবীন রাজনীতিকেরা আরাফাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আরাফাত তখন হামাস ও ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের কয়েক শ নেতা-কর্মীকে বোমা ছোড়ার অভিযোগে আটক করার নির্দেশ দেন।
নবীন রাজনীতিকেরা মারওয়ান বারগুতিকে গ্রেপ্তারকৃতদের নাম প্রকাশে চাপ দেন। আরাফাত এমন দাবি-দফার মুখে আগে কখনো পড়েননি। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের তাঁর প্রতি ছিল অগাধ আস্থা। অসলো চুক্তির পর বোমা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে যেখানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছে, সেখানে নবীন রাজনীতিকেরা চ্যালেঞ্জ করে বসবেন—এ ছিল অকল্পনীয়।
অসলো শান্তিচুক্তির পর নতুন আশা ও স্বপ্ন দেখেছিলেন ফিলিস্তিনিরা। যদিও কোথাও কোথাও তখনো আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলিদের মধ্যেও বড় অংশই এই চুক্তির বিরোধী ছিলেন।
তবে ২০০০ সালের গ্রীষ্মে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর বারগুতি হতোদ্যম হয়ে পড়েন। তিনি ক্ষোভ-বিক্ষোভের পাশাপাশি নতুন ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামপূর্ণ দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সম্ভাবনা দেখছিলেন।
ওই বছর সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের হারাম আল শরিফে প্রবেশ করেন, যেখানে আল আকসা মসজিদের অবস্থান। ফিলিস্তিনিরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বারগুতিও এবার অসলো শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার নেতৃত্বে দেন। তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলিদের বল প্রয়োগ করে বের করে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। অনলবর্ষী বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ করেন ফিলিস্তিনিদের। তবে তিনি ইসরায়েলের ভেতর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
বারগুতি অভিযোগ করেন, ইসরায়েল বরাবর শান্তির চেয়ে জমিকে এগিয়ে রেখেছে। শান্তিচুক্তি ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী তারাই।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ফাতাহর অন্যতম নেতা ও দলটির সশস্ত্র শাখা তানজিমের প্রধান হিসেবে বারগুতি ইসরায়েলি ফাঁড়ি অভিমুখে মিছিল-সমাবেশ শুরু করেন। পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলতে থাকে।
একই সময়ে ফাতাহ ও তানজিমের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আল আকসা মার্টার্স ব্রিগেড। ব্রিগেড ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারী ছাড়াও ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বারগুতির বিরুদ্ধে এই ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার অভিযোগ তোলে। তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও ব্রিগেডের কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
২০০১ সালে বারগুতিকে নিশানা করে ইসরায়েলিরা মিসাইল ছোড়ে। একটুর জন্য তিনি বেঁচে যান, মিসাইল গিয়ে পড়ে তাঁর দেহরক্ষীর গাড়ির ওপর। এরপরই এক বিবৃতিতে ব্রিগেড জানায় বারগুতি তাঁদের নেতা।
ওই বছর এপ্রিলে বারগুতিকে রামাল্লা থেকে গ্রেপ্তার করেন ইসরায়েলি সেনারা। পরবর্তী আগস্টে তাঁকে ইসরায়েলি আদালতে প্রথমবারের মতো তোলা হয়। ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি।
বিচার চলাকালীন বারগুতি ইসরায়েলি আদালতের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর আইনজীবীদের যুক্তি ছিল বারগুতি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনিই বরং ফিলিস্তিনকে দখলে নেওয়ার দায়ে ইসরায়েলকে কাঠগড়ায় নিতে চান।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পক্ষে ২০০২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে বারগুতির একটি মতামত প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই আত্মরক্ষার অধিকার আছে। তিনি আরও লেখেন, ‘আমি এবং ফাতাহ (যে দলের আমি সদস্য) ইসরায়েলের ভেতরে বেসামরিক জনগণকে নিশানা করে হামলা চালানের বিরোধী। কারণ, ইসরায়েল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিবেশী। কিন্তু সেই সঙ্গে দ্ব্যর্থহীনভাবে আমি বলতে চাই, আত্মরক্ষা, ইসরায়েলি দখলদারি থেকে দেশরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার শতভাগ অধিকার আমার আছে।’
বারগুতির কথা ছিল পরিষ্কার। একাধিক লেখায় তিনি বলেছেন, যদি অবরুদ্ধ অবস্থায় ফিলিস্তিন ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা করবে বলে আশা করা হয়, তাহলেও ইসরায়েলের কাছ থেকে আশা করতে হবে যে ফিলিস্তিনিরা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবেন। এর মধ্যেই আলোচনা চলবে।
কারাগারে থেকেও বারগুতি ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ২০০৩ সালের জুনে ফিলিস্তিনে বিবদমান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তিনি অস্ত্রবিরতি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন।
তবে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়নি। দুই মাস পর এক ফিলিস্তিনির আত্মঘাতী বোমা হামলা ও আকাশ থেকে ইসরায়েলি হামলায় হামাসের একজন রাজনৈতিক নেতা নিহত হন।
২০০৬ সালে বারগুতি প্রিজনার্স ডকুমেন্টের খসড়া প্রণয়ন করেন। সব কটি দলের কারাবন্দী নেতারা ১৯৬৭ সালের আগের সীমারেখা অনুসরণে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন ও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের দাবি জানান।
২০০৭ সালে ফিলিস্তিনের জন্য একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনে ‘মক্কা চুক্তি’ প্রণয়নেও যুক্ত হন বারগুতি।
এ সময়েই ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন বারগুতি। ইয়ং গার্ডের সাবেক আরও দুই সদস্য গাজার সেই শক্তিশালী মানুষ মোহাম্মদ দাহলান এবং আরাফাতের সাবেক সহযোগী জিবরিল রজবও তাঁর সঙ্গে সদস্যপদ পান। তাঁদের প্রত্যেকের বয়স এখন পঞ্চাশ ও ষাটের কোঠায়।
কারাগার থেকে মারওয়ান বারগুতির লেখা কিছু চিঠি বাইরে বেরিয়ে গেছে। সেই চিঠিতে তিনি বলছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি আপস-মীমাংসায় সংকটের সমাধান হবে না।
২০১৫ সালে গার্ডিয়ানে মারওয়ান বারগুতির যে লেখা প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি বলেন, মূল সমস্যা ইসরায়েল শান্তি প্রতিষ্ঠায় নয়, দখলে মনোযোগী। দখলকেই তারা এগিয়ে রেখেছে। আপস-মীমাংসার একটা ধুয়া তুলে তারা তাদের ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র এ কথা জানে। তারপরও তারা না বোঝার ভান ধরে বসে আছে। অতীতের ব্যর্থ উদ্যোগকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাজির করছে। বলার চেষ্টা করছে, ওই উদ্যোগ মেনে নিলেই মুক্তি ও শান্তি দুই-ই মিলবে।
দুই দশক ধরে কারাগারে থেকেও বারগুতি প্রাসঙ্গিকতা হারাননি। এই কৃতিত্বের অনেকটাই দিতে হবে তাঁর স্ত্রী আইনজীবী ও ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ফাদওয়া বারগুতিকে।
ফাদওয়া ও বারগুতি রামাল্লা শহরের বাইরে কোবার গ্রামে একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। ফাদওয়া তাঁর গ্রামে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া প্রথম নারী। ১৮ বছর বয়সে তিনি ওমেন্স ইউনিয়ন ফর সোশ্যাল ওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাকালীন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হন। এখন এ সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। সংগঠনটির কাজ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বারগুতি ১৮ বছর বয়সে যখন ইসরায়েলি কারাগারে ৫ বছরের জন্য জেল খাটতে যান, তখন ফাদওয়ার বয়স ১৪। কয়েক বছর পর ফাদওয়ার কাছে তিনি জেলফেরত এক ফিলিস্তিনিকে দিয়ে খবর পাঠান। তাঁকে উদ্ধৃত করে ফাদওয়া বলেন, ‘সে এসে বলল, মারওয়ান বারগুতি আমাকে ভালোবাসে। সে চায় আমি যেন তার জন্য অপেক্ষা করি।’
শেষ পর্যন্ত বারগুতি যখন মুক্তি পেলেন, তখন খুবই অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এলেন। বললেন, তিনি টাকাপয়সা, ধনদৌলত, বাড়িঘর বোঝেন না। তিনি তাঁর হৃদয় ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের কাছে সঁপে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি দিলেন, যখন ফিলিস্তিন মুক্ত হবে, তখন তাঁরা একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন কাটাবেন। কিন্তু ফাদওয়াকে ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তাবটি ভেবে দেখার জন্য এক সপ্তাহ সময়ও দিলেন।
ফাদওয়া কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে একমুহূর্তও দেরি করেননি। তিনি বলেন, ‘আমার এক সপ্তাহ সময় লাগবে না। ফিলিস্তিন শুধু তোমার না, আমারও, আমাদের সবার। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির এই আন্দোলনে আমি আমৃত্যু তোমার পাশে থাকব।’ এই দম্পতি চার সন্তানের মা–বাবা। একটি সন্তান জন্মের সময়ও ফাদওয়া বারগুতিকে কাছে পাননি।
বারগুতির এই দুই দশকের কারাজীবনে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের কাজটি চালিয়ে গেছেন ফাদওয়া। তাঁর মারফতই বারগুতি জানিয়েছেন, তিনি এখন সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধের পক্ষে। ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন কারাগারে বারগুতি বন্দীদের নিয়ে অনশন করেছেন। এ নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে অতিথি কলামে বারগুতি লিখেছেন। সহযাত্রী হিসেবে পাশে পেয়েছেন স্ত্রী ও অগণিত ফিলিস্তিনিকে।
গত আগস্টে ফাদওয়া বারগুতি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক, আরব বিশ্ব ও ইউরোপীয় বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বারগুতি যেন প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির প্রধান আব্বাসের পর দায়িত্ব নিতে পারেন, তা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন। এসব বৈঠকে জর্ডান ও মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আরব লিগের মহাসচিবেরাও ছিলেন। তবে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু জানানো হয়নি।
নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বারগুতি মুক্তি পাবেন—এ এক দুরাশা। কিন্তু একটা সময় তো আরাফাতের দেশে ফেরাও সমান অসম্ভব ছিল।
দুই দশক ধরে সব কটি মতামত জরিপে কারাবন্দী বারগুতি ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তাঁর মিলে খুঁজে পান ফিলিস্তিনিরা। একটি স্বাধীন–নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফিলিস্তিনি এই ম্যান্ডেলার জয় ঠেকিয়ে রাখা হবে অসম্ভব।
কারণ, বহুধাবিভক্ত ফিলিস্তিনে বারগুতি একজন মধ্যপন্থী নেতা। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী কিংবা ইসলামপন্থী—দুদলের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্বের সূত্রপাত কারাগারে। পশ্চিমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বে নাখোশ হামাসও বারগুতির মুক্তি চায়। এ কথা বলার কারণ, পশ্চিমাদের মধ্যেও বারগুতির বন্ধু আছেন।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো খালেদ এলগিনদি বলেন, ফিলিস্তিনের বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে এই মুহূর্তে মারওয়ান বারগুতির মুক্তি গুরুত্ব বহন করে। সবদিক থেকে বারগুতি একজন সম্মানীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তিনি একতার প্রতীক। আর এই মুহূর্তে ঐক্যটাই সবচেয়ে জরুরি।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, আল–জাজিরা, লু মন্দ, ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে লেখা।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo. com