মায়ের মৃত্যুতে সন্তানের কান্নাকেও ডান্ডাবেড়ি পরানো যায়, অশ্রুপাতকে পরানো যায় হাতকড়া। এ কেমন দুর্ভাগা সন্তান, মায়ের জানাজা পড়াতে যাঁকে দাঁড়াতে হয় হাতে–পায়ে শিকল নিয়ে? বাংলাদেশ এমন দৃশ্যও দেখল? আপনি আসামি হতে পারেন, আপনি দণ্ডিতও হতে পারেন, কিন্তু আপনার শোকের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। শোককে শাস্তি দেওয়া যায় না। আইন তার অনুমোদন দেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে সবই সম্ভব। সব সম্ভবের এই দেশে সময় যেন থমকে আছে। তা না হলে একুশ শতকের বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখা যাওয়ার কথা না। রাষ্ট্র ও তার পুলিশ, যাকে আমরা কর্তৃপক্ষ বলে থাকি, তারা এমন পাষাণ কীভাবে হলো? মাতৃহারা সন্তানের জন্যও তাদের মনে কোনো রহম জাগল না? নাকি অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপির কেউ হলে তাঁকে নিয়ে যা খুশি করা যায়?
মামলার পরিচয়—‘গায়েবি’। ব্যক্তির পরিচয়—তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার একটি ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি। নামে প্রকাশ আলী আজম। আলী আজমের বৃদ্ধ মা যখন মারা যান, তখন তিনি গায়েবি মামলার আসামি হয়ে কারাগারে। মায়ের জানাজা পড়ার জন্য তিনি জেলা প্রশাসক বরাবর প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন। তা মঞ্জুরও করা হয়। তিন ঘণ্টার জন্য তিনি কারাগারের বাইরে আসতে পারেন। নয়–নয়জন পুলিশ সদস্যের পাহারায় থাকা ব্যক্তিকে নাহয় হাতকড়া পরানো হলো; কিন্তু ডান্ডাবেড়ি কেন? তিনি কি ভয়ংকর কেউ, নাকি কোনো দুর্ধর্ষ দস্যুসরদার?
আমরা শুধু একজন নাগরিকের প্রতি নির্দয়তা দেখে ব্যথিত নই, আমরা চিন্তিত প্রশাসনযন্ত্রের অমানবিক হয়ে ওঠা নিয়ে। ঘটনা তো একটি নয়। হরহামেশাই এসব দেখে ক্ষোভে, হতাশায় কুঁকড়ে যেতে হয়। এটা কেবল একজনের প্রতি করা অন্যায় নয়, এমন দৃশ্য মানুষের অনুভূতিকে আঘাত করে, মানবতাকে চরম পরিহাস করে। এমন দৃশ্য দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তির ওপর নিষ্ঠুরতার সিলমোহর বসিয়ে দেয়। নাগরিক হিসেবে এটা কারোরই প্রাপ্য হতে পারে না।
কী অদ্ভুত বাস্তবতা! আদালতের সামনে থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে অবলীলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিরা পালিয়ে যায় আর বিতর্কিত মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মায়ের জানাজায় হাজির হতে হয় ডান্ডাবেড়ি–হাতকড়া পরা অবস্থায়।
২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে বিচারাধীন আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলার বিরুদ্ধে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশে বলা হয়েছে, কোনো আদালতের এজলাসেই বিচারাধীন আসামির সঙ্গে এটা করা যাবে না। বিষয়টার গুরুত্ব বোঝা যায় এখান থেকে যে ওই ঘটনায় আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানোর জন্য কারা বিভাগের ডিআইজির কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন এবং ডিআইজি প্রিজন এই ঘটনার জন্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান। আমাদের সংবিধানেও এমন আচরণের বিরুদ্ধে নীতিমালা রাখা হয়েছে। জেল কোডেও বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু নয়, দণ্ডিত আসামির হাতে–পায়ে বেড়ি পরানোয় নিষেধ আছে।
কী অদ্ভুত বাস্তবতা! আদালতের সামনে থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে অবলীলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিরা পালিয়ে যায় আর বিতর্কিত মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মায়ের জানাজায় হাজির হতে হয় ডান্ডাবেড়ি–হাতকড়া পরা অবস্থায়। যাঁরা এর নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁরা কি দয়া করে সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদটা আবার পড়ে দেখবেন? সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। আলী আজম কেন সংবিধানে দেওয়া এই সুরক্ষার দাবিদার হবেন না? বিএনপি করেন বলে? বিএনপি করেন বলেই এমন এক মামলার আসামি করা হয়েছে তাঁকে, স্বয়ং মামলাকারীই যে মামলাকে অস্বীকার করেছেন!
প্রথম আলোর ২১ ডিসেম্বরের খবরে জানা যাচ্ছে, মামলার বাদী মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার মামলা সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি ছিলামও না, দেখিও নাই।’ তারপরও আলী আজমসহ ১১ জনকে স্বনামে এবং আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা হিসেবে। মামলার মেরিট তাহলে কোথায়? গায়েবি মামলার ভয়াল থাবায় কত মানুষ কত পরিবার যে শেষ হয়ে গেছে! টনক নামের বস্তুটি যদি জীবিত ও সক্রিয় থাকত, অবশ্যই নড়ে উঠত। পাথরেও টোকা দিলে শব্দ হয়, কিন্তু প্রশাসন নামক জিনিসটা লাগাতার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিয়ে পাথরের চেয়ে কঠিন ও হৃদয়হীন থাকে। কারও জন্যই এটা কোনো ভালো খবর নয়।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com