যে কারণে সরকারের ঋণ বিপজ্জনক পর্যায়ে যেতে পারে

গত ৩০ এপ্রিল দৈনিক বণিক বার্তার প্রথম পৃষ্ঠার মূল শিরোনাম ছিল, ‘জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব বাড়ছে না, বাড়ছে সরকারি ঋণ’। অত্যন্ত তথ্যবহুল এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাত হিসেবে সরকারি রাজস্ব আয় ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ, কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অনুপাত আরও কমে মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু কর-জিডিপির অনুপাত বিবেচনা করলে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে, যা সত্যিই লজ্জাজনক। দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সরকারি রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ও কর-জিডিপির অনুপাত এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল, কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই দুই অনুপাত ক্রমে আরও কমছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে অবস্থান করছে, সেখানে রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ার কথা আয়কর। কিন্তু বর্তমানে আয়কর রাজস্ব আহরণের তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত হিসেবেই রয়ে গেছে। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সাপ্লিমেন্টারি ডিউটিসহ আমদানি শুল্কের অনেক পেছনে রয়েছে আয়কর থেকে অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ। রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ও কর-জিডিপির অনুপাত এত কম থাকলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণামে সরকারি ঋণ ক্রমে বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না।

বাংলাদেশেও ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমেই জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ প্রতিবছর বাড়াতেই হচ্ছে। ফলে ২০১৪ সালে আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেখানে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৪২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক রকমের বেশি হয়ে গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ অতি দ্রুত অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয়-বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ রাখতে হয়েছে সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে—মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষে এই খাতে প্রকৃত ব্যয় আরও বাড়তে পারে।

আগামী বছরেই সুদ পরিশোধ খাতে সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ বর্তমান বাজেটের আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

এভাবে করপোরেট আয়কর কমিয়ে দিলে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয় না? আর ব্যক্তিগত আয়কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর সময়ে যে নানা রকম আয়কর মেলা এবং প্রণোদনা নীতি ঘোষণা করতেন, সেগুলোও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সময় অনেকখানি গুরুত্ব হারিয়েছে। উপজেলা পর্যন্ত আয়কর বিভাগ সম্প্রসারণের যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল, সেটি শ্লথ করে দেওয়া হলো কেন?

সরকারের মোট ঋণের বোঝা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া বর্তমান পর্যায়ে খুবই গুরুত্ববহ। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১৬৭ বিলিয়ন ডলারে। ১ ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত ১০৮ টাকা ধরে হিসাব করলে টাকার অঙ্কে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা (৯৫.০৭ বিলিয়ন ডলার) অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত সরকারি ঋণ, আর ৮ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা (৭১.৯৩ বিলিয়ন ডলার) হলো সরকারের বৈদেশিক ঋণ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটঘাটতি দেখানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে বর্তমান বাজেটে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা ব্যাংকগুলো পূরণ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার অস্বাভাবিক হারে এ বছর ঋণ নিয়েছে।

সরকারের রাজস্ব আহরণেও এ বছর বড়সড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্বঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এ বছর অস্বাভাবিক হারে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য এহেন রাজস্বঘাটতিই প্রধানত দায়ী। আমরা কিছুদিন আগে আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ নিয়েছি, তার প্রথম কিস্তি ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যেই সরকারের কর-জিডিপির অনুপাতকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে বাড়িয়ে ফেলতে হবে এবং আইএমএফ কর্তৃক ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাতকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান প্রবণতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই দুটো শর্তের কোনোটাই আমরা পূরণ করতে পারব না।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ আগের বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ১৬ শতাংশ কমে গেছে, যাকে সরকারের জন্য ‘অশনিসংকেত’ মনে করি। প্রবাসী আয়ে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে দমনে ব্যর্থতা আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেই যাবে। উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ও তেমন বাড়ছে না।

অন্যদিকে, জিডিপির অনুপাত হিসাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত না হলেও বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে সরকারের খামখেয়ালি বিনিয়োগের স্পৃহা এখনো অব্যাহত থাকায় অতি দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বেড়ে চলেছে। স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা থেকে সরকারকে কোনোমতেই হটানো যাচ্ছে না!

এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের নানা সূত্র থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের অদম্য আগ্রহ, যার ফলে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণও বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এসব ঋণের গ্যারান্টার হতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। এই একটি কারণে গত এক বছরে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড়সড় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো থামানো যাবে না।

বর্তমান ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একেবারেই বেমানান। আয়করের প্রধান উৎস করপোরেট আয়করের হারকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী কয়েক দফায় কমিয়ে দিয়েছেন।

এভাবে করপোরেট আয়কর কমিয়ে দিলে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয় না? আর ব্যক্তিগত আয়কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর সময়ে যে নানা রকম আয়কর মেলা এবং প্রণোদনা নীতি ঘোষণা করতেন, সেগুলোও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সময় অনেকখানি গুরুত্ব হারিয়েছে। উপজেলা পর্যন্ত আয়কর বিভাগ সম্প্রসারণের যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল, সেটি শ্লথ করে দেওয়া হলো কেন?

দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মানুষের এক কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হলো না কেন? প্রয়োজনে আয়কর বিভাগে জনবল বাড়িয়ে এবং নতুন ব্যক্তি থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করে আয়কর সংগ্রহে গতিশীলতা সৃষ্টি করা হোক।

দেশে প্রায় পঁচাত্তর লাখ মানুষ ই-টিন নিয়েছেন বলে আয়কর বিভাগ জানিয়েছে। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশকেও এখনো আয়করের আওতায় আনা গেল না কার ব্যর্থতায়? রাজস্ব খাতকে চাঙা করার লক্ষ্যে দু-তিন বছরের মধ্যে সরকারের রাজস্বের প্রধান খাত হিসেবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঘোষণা করা হোক আগামী বাজেটে।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক