পাঁচ প্রদেশ নতুন অনেক সমস্যার জন্ম দেবে

‘রাষ্ট্র সংস্কার’, ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কিংবা ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’—এই বিশেষ ইস্যু নানা নামে সুদীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তি, সংগঠন এবং সময়-সময় আইন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আলোচনা করে আসছেন। বিগত দিনে নুরুননবী চৌধুরী, ফজলুর রহমান, এ টি এম শামসুল হক, আকবর আলি খানকে প্রধান করে কিছু কমিটি এ বিষয়ে কাজ করেছে। নানা কারণেই সেই কমিটিগুলো বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি।

এখন দেশে একটি ভিন্ন ধরনের সরকার ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের নতুন বন্দোবস্ত, সংস্কার ও মেরামতের একটি বিপ্লবী অঙ্গীকার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। ৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোয় সংস্কার বিষয়ে তিনজন উপদেষ্টা—সালেহউদ্দিন আহমেদ, আসিফ নজরুল ও এম সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে সংস্কারের দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। সংবিধান, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্যসহ ছয়টি খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন করার ঘোষণা দিয়েছেন। 

সংস্কার ও নতুন বন্দোবস্তের যে চিন্তাগুলো প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে, তার বাস্তব সমস্যা হচ্ছে সংস্কারের সঠিক ক্ষেত্রগুলো এখনো সঠিকভাবে চিহ্নিত নয়। কথাগুলো এখনো অনেকটা বিমূর্ত এবং একধরনের আলো-আঁধারির অস্পষ্টতায় পুরোপুরি দৃশ্যমান নয়। দেশে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয় আছে, যার জন্য সংবিধান পরিবর্তন ও নতুন আইন করা প্রয়োজন নেই। শুধু সরকারের দৃঢ় ইচ্ছা ও ত্বরিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সেবা–সম্পর্কিত বহু সমস্যার সমাধান রাতারাতি হতে পারে। কিন্তু নিত্যদিনের আলোচিত সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপ্তি ও পরিধি অনেক ব্যাপক। সংবিধান সংস্কার বা পরিবর্তন ছাড়া বড় সংস্কারগুলো করা অসম্ভব। সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠন করায় আশা করা যায় সংস্কারচিন্তা একটি বাস্তব কাঠামো পাবে। 

দুই.

অন্তর্বর্তী সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘রাষ্ট্র মেরামতের এখনই সময়’ শীর্ষক একটি কলামে রাষ্ট্র সংস্কারের ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরেন। তাঁর সেই প্রস্তাবকে নিয়েই আমার আজকের এই নিবন্ধ। সাখাওয়াত হোসেনের শেষ পাঁচটি প্রস্তাব হচ্ছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দল–সম্পর্কিত আইন, পুলিশ কমিশন ও প্রশাসন এবং বিচারপতি নিয়োগে পর্ষদ গঠন। এ পাঁচ প্রস্তাবের বক্তব্য সাধারণভাবে মোটাদাগে গ্রহণ করে আলোচনা হতে পারে। 

কিন্তু প্রথম প্রস্তাবটিতে এম সাখাওয়াত হোসেন ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ উপশিরোনামে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে যে বিষয়টির অবতারণা করেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত নই। বিকেন্দ্রীকরণ অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত একটি বিষয়। এ বিষয়ে ইংরেজি–বাংলায় আমার ছয়টি গ্রন্থ আছে।

আমি এখানে শুধু সাখাওয়াত হোসেনের বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তার দুটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘ফেডারেল রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখতে চান। এ ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর অধীন পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি করে চারটি ও ঢাকাকে নিয়ে একটি মোট পাঁচটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাব একবারে নতুন নয়। জেনারেল এরশাদ বিরোধী দলে থাকাকালে এবং জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবও একসময় এ দাবি করেছিলেন। আমি তখনো তখনকার প্রেক্ষাপটে এ দাবির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম। 

এখনকার প্রেক্ষাপটেও প্রদেশ গঠনের চিন্তাকে নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য সঠিক মনে করি না। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসী ছাড়া বাকি বাংলাদেশের ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থা, সমাজ-সংস্কৃতি সমজাতীয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য তাই সমতল থেকে পৃথক ধরনের জেলা পরিষদ ও তিন জেলা মিলে একটি আঞ্চলিক পরিষদ রয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বজনীন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অধীন তিন স্তরের নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি সেখানে চিপ বা রাজার অধীন হেডম্যান-কারবারি-বাজার চৌধুরী নিয়ে একটি ভূমিজাত কাস্টমারি সিস্টেমের আইনি স্বীকৃতি রয়েছে। সমতলভূমির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীদের বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ইউনিয়ন পরিষদে একটি নতুন পরিসর দেওয়া যেতে পারে।

যেহেতু নেপাল বা ভারতের মতো বাংলাদেশিরা বহুজাতিক, বহুভাষিক, প্রকটভাবে ধর্মীয় বিভাজনে বিভাজিত এবং ভৌগোলিকভাবেও বিচ্ছিন্ন ও বিভাজিত নয়, তাই এখানে শুধু জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে পাঁচটি প্রদেশ গঠন করা হলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক—এ তিনটি দিকে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে আমার প্রাথমিক ধারণা। 

এ দেশে ‘প্রদেশ’ সমস্যা সমাধানের বদলে বহু নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমত, পাঁচটি প্রদেশে যদি ধরে নিই ৫০০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হবেন। জাতীয় সংসদ সদস্যের মতো তাঁদের নানা সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি, বাড়ি, সংসদ ভবন, প্রাদেশিক সচিবালয় ইত্যাদির প্রয়োজন পড়বে। ধরে নিলাম প্রতিটি প্রদেশে ১০ থেকে ১৫ জন প্রাদেশিক মন্ত্রী হবেন। তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে। ৩৫০ জন জাতীয় সংসদ সদস্য ও ৩০ থেকে ৩৫ জন মন্ত্রীর ভারে জাতি ন্যুব্জ। আরও ৫০ থেকে ৬০ জন মন্ত্রী ও ৫০০ সংসদ সদস্যের বোঝা বহন করা এ জাতির জন্য দুরূহ ও দুর্বহ শুধু নয়, রাজনৈতিকভাবে অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।

শক্তিশালী ও জনসম্পৃক্ত একটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে একটি ভালো বিকল্প হিসেবে কাজে লাগবে। এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমার সুপারিশ, প্রশাসনের বিভাগীয় স্তর বিলুপ্ত করে সে জনবল জেলায় কাজে লাগানো যেতে পারে। জেলা প্রশাসনকে অধিকতর শক্তিশালী ও জেলা পরিষদকে একটি সত্যিকারের জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা যেতে পারে। 

পরিকল্পনা কমিশন জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনকে একটি ‘জেলা পরিকল্পনা’ করতে সহায়তা করবে এবং জেলায় একটি বাজেট হতে পারে। দেশের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার পাশাপাশি ৬০টি জেলায় ৬০টি আঞ্চলিক পরিকল্পনা হতে পারে। বিএনপির ড. মঈন খান এবং আওয়ামী লীগের আবুল মাল আবদুল মুহিত এ রকম একটি চিন্তা করেছিলেন।

জেলার বিচার প্রশাসন ও রেগুলেটরি প্রশাসনিক দপ্তরগুলো ছাড়া সাধারণ, সেবা ও উন্নয়ন প্রশাসন—সব বেসরকারি উন্নয়ন ও সেবা উদ্যোগ জেলা পরিষদের মাধ্যমে সমন্বিত হবে এবং জেলা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হবে। এটি হবে বিরাজিত ব্যবস্থার অধীন আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য ও সহনীয় সংস্কার। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত স্থানীয় সরকার আইন, স্থানীয় সরকারের নতুন জনবল নীতি, অর্থায়ন, আন্তপরিষদ সম্পর্ক, জাতীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এবং স্থানীয় মাঠ প্রশাসন ও সেবা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ণয় করতে হবে।

এম সাখাওয়াত হোসেনের অন্যান্য প্রস্তাব, বিশেষত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রাদেশিক পরিষদের অভাব পূরণ করবে। তার সঙ্গে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী পদ্ধতি যুক্ত হলে সোনায় সোহাগা। বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে একটি সুপারিশ, তা হলো উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত সম্প্রসারণ। এটি করা হলে দেশের প্রান্তিক মানুষ অনেকভাবে উপকৃত হবে।


ড. তোফায়েল আহমেদ অধ্যাপক ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ