গোবিন্দগঞ্জ বাগদাফার্ম এলাকা। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় খিয়ার এলাকা। মাটির চুলা পুড়ে পুড়ে যে রং হয়, সেই রংটাই খিয়ার। দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত বেরোলে চুলার এই খিয়ার মাটি দিয়ে দাঁত মাজতে হয়। নোনতা লাগে।
চারদিকে রাস্তাসমান উঁচু জমি। যত দূর চোখ যায়, সেই জমিতে ধানের চারা ঘন হয়ে থোপায় থোপায় একাকার। আর দারিদ্র্যের চূড়ান্ত চেহারা নিয়ে গবাদিপশুর খোঁয়াড়ের মতো একটি করে ছাপরা ঘর নিয়ে একটি বাড়ি। দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকা কুড়িগ্রামেও এ রকম পর্ণকুটির চোখে পড়েনি। কুড়িগ্রামের গোয়ালঘরও এর চেয়ে উন্নত।
রাস্তার পাশের একটি ফাঁকা শুকনা মাঠ ছিল গত ৮ এপ্রিলের এর জনসভাস্থল। যদিও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের শহীদ মিনারে জনসভা করার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সুপারের কার্যালয় অনুমতি দিয়ে আগের দিন জনসভাস্থল বদল করতে বলে।
চারদিক থেকে জমির আল ধরে কালো মানুষেরা আসছেন। যে শামিয়ানা চৈত্র্যের কড়া রোদকে ঠেকাতে পারছে না, মাটিতে বসে পড়া শত শত নারী-পুরুষ তা তাঁদের শরীর দিয়ে ঠিকই ঠেকিয়ে দিচ্ছেন। চিরক্ষুধার্ত মনুষ্যতর শরীর। তাঁদেরই তিনজন শ্যামল হেমব্রন, মঙ্গল মারডি ও রমেশ টুডু, ২০১৬ সালে ৬ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। হাইকোর্টের বিচারিক তদন্তেও তা প্রমাণিত। তারপর তাঁদেরই নামে উল্টা মামলা দেওয়া হয়।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নারাংগাবাদ, চকরাহিমপুর এলাকা) বাগদাফার্ম এলাকায় ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি ছিল সাঁওতালদের। ১৯৫৬ সালে মহিমাগঞ্জ চিনিকল প্রতিষ্ঠা হয়। পূর্ব পাকিস্তান (জরুরি) সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন ১৯৪৮ অনুসারে আখ চাষ ও সরবরাহের জন্য অধিগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার ১৯৪৮ সালের আইন অনুসারে একটি চুক্তি করে। সেখানে বলা হয় যে আখ চাষের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলো, তা না হলে ক্ষতিপূরণসহ জমি ফেরত দেওয়া হবে।
২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যায়। চাইলে আখ চাষের ফলন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে, সার-বীজ ক্রয়ে প্রণোদনা দিয়ে, কৃষকদের সময়মতো পাওনা পরিশোধ করে, আখ আহরণের পরপরই সুক্রোজের পরিমাণ কমতে না দিয়ে, উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ করে ও বিতরণব্যবস্থা উন্নত করে চিনিকলটি স্বাবলম্বী করা যেত, কিন্তু তা না করে জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে লিজ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদ করা হলে চিনিকলের কর্তাবাবুরা লিজ বাতিল করেন। মিলের নামেই পুকুর খনন করা হয়, অন্যান্য ফসল আবাদ করা হয়।
একপর্যায়ে সাঁওতাল ও বাঙালিরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের জমিতে ফিরে আসতে শুরু করেন। তাঁরা গড়ে তোলেন সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি। এ রকম পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের ১০ মে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ওই জমিকে অনাবাদি ও অব্যবহৃত দেখিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। অথচ সেখানকার বেশির ভাগ জমি ৩ থেকে ৪ ফসলি ও উঁচু জমি।
২০১৬ সালের ৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে বাগদাফার্ম এলাকায় সমাবেশ করেন সাঁওতাল-বাঙালি কৃষকেরা। ছয় হাজার নারী-পুরুষ পূর্বপুরুষের জমি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। ১ জুলাই থেকে তাঁরা সেখানে ঘর তোলা শুরু করেন।
৬ নভেম্বর ২০১৬। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দেওয়া হাড় জিরজিরে মানুষগুলো ঠান্ডায় কাঁপছিল। সে রকম এক সকাল। আল–জাজিরার ভিডিওতে দেখা যায়, কীভাবে পুলিশ স্থানীয় মাস্তানদের সঙ্গে নিয়ে সাঁওতালদের পর্ণকুটিরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এ সময় গুলিতে তিনজন নিহত হন আর কয়েকজন পঙ্গু হয়ে যান।
১৯৩৩ সালে জিতু ও সামুর নেতৃত্বে এ অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে। সে সময় ২০ হাজার সাঁওতাল ভিটেহারা হন। ১৯৪৭–এর দাঙ্গা পরবর্তী সময় একবার, ১৯৫০ সালের নাচোলের কৃষক বিদ্রোহে আরেকবার এবং ’৬২–র দাঙ্গায় ব্যাপক সংখ্যায় বাড়িঘর ছাড়তে হয় তাঁদের। ’৬২ সালেই ভূমি রেকর্ড হয়। তাঁদের জমি ক্ষমতাসীনেরা রেকর্ড করে নেয়। ১৯৬৫–এ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তাঁদের জমি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়। অথচ তাঁদের বলা হয়েছিল, ‘তোরা বন কেটে আবাদ করবি/তোদের আবার খাজনা কিসের।’
বাহাত্তরের সংবিধানেও ভূমির মালিকানায় যৌথ মালিকানার বিষয়টি অস্বীকৃত হয়।
ফলে সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা প্রভৃতি জাতি, যারা শত শত বছর ধরে যৌথ মালিকানা ভোগ করছিল, তারা তাদের জমির অধিকার হারায়। ১৯৮৪ সালে নতুন ভূমি মালিকানা তৈরি হয়, তাতে যে ২ লক্ষ ৬০ হাজার খাসজমি দেখানো হয়, তার বড় অংশই ছিল এসব জাতিগোষ্ঠীর যৌথ মালিকানার জমি। এভাবেই দিনে দিনে রাষ্ট্র নিজ নাগরিকদের উদ্বাস্তু পরিণত করেছে। এই নজির বিরল। এখন নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আবারও প্রভাবশালীরা নেমেছে লিজ নেওয়ার চক্রান্তে। ৮ এপ্রিলের সমাবেশে সাঁওতাল নেতা শ্রীকান্ত মাহাতো তাঁর বক্তৃতায় বলেন, আমরা কি খাসজমি চাইছি? নিজের জমি চাইছি।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com