পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ২ অক্টোবর প্রথম আলোয় যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা জাতির জন্য সুখকর নয়। আর সেই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য তা মর্যাদাকর নয়। প্রতিবেদনটি সমস্যার ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। কিন্তু সমস্যার মূল খুঁজে তার সমাধান করতে না পারলে আমাদের শিক্ষার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
আমাদের দেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্য থেকে মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের রেওয়াজ আছে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতি অনুসরণ করা হয়।
অর্থাৎ অন্যান্য দেশে গবেষণা শিখে শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হয়। আর আমাদের দেশে গবেষণার হাতেখড়ির আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া যায় এবং তারপর তাঁকে গবেষণা শিখতে হয়।
গবেষণা শেখার জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের গবেষক হয়ে ওঠার মানসিকতা, চেষ্টা, অর্থ, উপযুক্ত মেন্টর ও প্রণোদনা। প্রথম দিকে গবেষক হয়ে ওঠার মতো মানসিকতা ও চেষ্টা অনেকের মধ্যে থাকলেও উপযুক্ত মেন্টর ও অর্থের অভাবে গবেষক হয়ে ওঠার স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রে ম্লান হয়ে যায়।
কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গবেষক মেন্টরদের’ সংখ্যা নেহাতই কম। এই জায়গা দখল করেছেন ‘রাজনৈতিক মেন্টর’। এই মেন্টরদের বেশির ভাগই প্রত্যক্ষভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দলের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত। আর সরকারি দলের অনুসারী হলে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিভিন্ন পদেও অধিষ্ঠিত হন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই মেন্টরদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আনুকূল্য না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া যায় না।
শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তাঁদের নিয়মিত দলীয় সভায় অংশগ্রহণ করতে এবং এই মেন্টরদের সাহচর্যেই বেশি থাকতে দেখা যায়। মেন্টরদের কাছ থেকে তাঁরা গবেষণার পরিবর্তে হাউস টিউটর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রক্টর কিংবা সিন্ডিকেট, সিনেট বা শিক্ষক সমিতির কোনো পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার দীক্ষায়ই বেশি পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে যেসব ‘গবেষক মেন্টর’ এখনো অবশিষ্ট আছেন, তাঁদের যদি রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা উপদলীয় বলয় অভিন্ন না থাকে, তাহলে তাঁরাও তেমন কাজে আসেন না।
অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক জার্নালে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রকাশনা থাকা বাধ্যতামূলক করা। অধ্যাপকদের মানসম্মত প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার বিধান চালু করা। মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা এবং ধরে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো চালু করা।
কেননা সদ্য যোগ দেওয়া একজন শিক্ষক ভিন্ন রাজনৈতিক দলের বা ভিন্ন উপদলীয় বলয়ের অনুসারী কোনো ‘গবেষক মেন্টরের’ সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ভয় পান। কারণ, এতে তাঁর রাজনৈতিক মেন্টর অতুষ্ট হতে পারেন। মোদ্দাকথা, উপযুক্ত ‘গবেষক’ মেন্টরের অভাবই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষক হয়ে না ওঠার একটি বড় কারণ। তাই পিএইচডি করার আগে অনেকের পক্ষে আর গবেষক হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
পরবর্তী সময়ে যাঁরা দেশে পিএইচডি করেন, তাঁদের বেশির ভাগকে যেনতেনভাবে গবেষণার কাজ শেষ করতে দেখা যায়। কারণ, তাঁদের ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্য প্রমোশন পাওয়া, গবেষক হওয়া নয়।
আর যাঁরা উন্নত বিশ্বে গিয়ে পিএইচডি অর্জন করে দেশে ফেরেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পিএইচডির প্রশিক্ষণকে কাজে লাগান না বা লাগানোর সুযোগ পান না। কারণ, পিএইচডি আমাদের দেশে প্রমোশনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে উন্নত বিশ্বে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই অনেকে পিএইচডি করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এবং গবেষণা করার আর প্রয়োজন মনে করেন না।
অথচ পিএইচডি হলো ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো। ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে কেউ ড্রাইভিং না করলে যেমন ড্রাইভিং ভুলে যান এবং লাইসেন্সসর্বস্ব কাগুজে ড্রাইভারে পরিণত হন; পিএইচডি করার পর নিয়মিত গবেষণা না করলে তেমনি শুধু সনদধারী কাগুজে গবেষক হন, প্রকৃত গবেষক হন না। আমাদের দেশে শিক্ষক হোন বা আমলা হোন, বেশির ভাগ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী এখন সনদধারী কাগুজে গবেষক।
গবেষণার জন্য একদিকে যেমন অর্থের প্রয়োজন, অন্যদিকে গবেষণালব্ধ ফলাফল উন্নত মানের ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশের জন্যও অর্থ প্রয়োজন। এসব অর্থের জোগান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণা বরাদ্দ প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। সারা বিশ্বে একাডেমিয়া এবং ইন্ডাস্ট্রির সম্পর্কের মাধ্যমে মৌলিক গবেষণা হয়। আমাদের দেশে এ সম্পর্ক এখনো জোরদার হয়নি। উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের প্রকাশনার একটা বড় অংশ তাঁদের অধীন গবেষণারত পিএইচডি গবেষকদের সঙ্গে হতে দেখা যায়, যা আমাদের ক্ষেত্রে প্রায় অনুপস্থিত। কেননা এখানে গবেষক ও তত্ত্বাবধায়ক কেউই গুণগত গবেষণায় মনোযোগী নন।
দু-একজন যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই উন্নত মানের ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশ করার চেষ্টা করেন না। কেননা উন্নত মানের জার্নালে লেখা সাবমিট করার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তার জন্য তাঁদের আর দম থাকে না। অন্যদিকে উন্নত মানের গবেষক হয়ে ওঠা এবং উন্নত মানের জার্নালে প্রকাশনার জন্য কোনো আর্থিক বা অনার্থিক প্রণোদনা নেই। স্বল্প পরিসরে যতটুকু প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা এবং গবেষক তৈরির একটি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে দরকার আইন করে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে রাজনৈতিক মেন্টরের পরিবর্তে গবেষক মেন্টর তৈরির পথ সুগম করা।
এর সঙ্গে প্রয়োজন প্রতি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে কমপক্ষে একজন রিসার্চ অধ্যাপক এবং দুজন রিসার্চ সহযোগী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করে সেখানে উপযুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া। প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদ সৃষ্টি করে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া। পরবর্তী সময়ে কর্মদক্ষতা অনুযায়ী তাঁদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে এমফিল সম্পন্ন করার ব্যবস্থা রাখা।
গবেষণার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য উপযুক্ত আর্থিক প্রণোদনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদানের ব্যবস্থা প্রচলন করা।
অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক জার্নালে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রকাশনা থাকা বাধ্যতামূলক করা। অধ্যাপকদের মানসম্মত প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার বিধান চালু করা। মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা এবং ধরে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো চালু করা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানের ভিত্তিতে জাতীয়ভাবে র্যাঙ্কিংয়ের আওতায় এনে র্যাঙ্ক অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো নির্ধারণ করা। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো চালুতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
সরকারকে এ ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক