মতামত

রাশিয়ায় ভাগনার বিদ্রোহে চীন কেন বিচলিত

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের ভাগনার গ্রুপ রাশিয়ায় যে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিয়েছে, তা সারা বিশ্বের সব রাজধানীর মনোযোগ কেড়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সম্ভবত অন্য কোথাও ততটা তোলপাড় হয়নি, যতটা হয়েছে বেইজিংয়ে।

রাশিয়া চীনের একটি বিশ্বস্ত অংশীদার। শুধু এই কারণে বেইজিং এতটা উতলা হয়নি। এর পেছনে আরও একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। কারণটি হলো, যে সপ্তাহান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভেদের ডঙ্কা বেজে উঠেছে, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে একইভাবে চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, যা চীনকে দুর্বল করে ফেলেছিল।

আজ রাশিয়ার সেনাবাহিনী চার–পাঁচটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। রাশিয়ার মূল বাহিনী ও ভাগনার গ্রুপের সশস্ত্র যোদ্ধারা ছাড়া দেশটিতে ছোট ছোট বাহিনী আছে। যেমন মস্কোর মেয়রের অধীনে একটি বাহিনী আছে; চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভের স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী আছে; এ ছাড়া রাশিয়ার মূল সেনাবাহিনীর বাইরে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কমান্ডের অধীনে বিশেষ ন্যাশনাল গার্ড বাহিনী আছে। এর বাইরে রাশিয়ার অলিগার্কখ্যাত ধনকুবেরদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ রক্ষায় নিজ নিজ বাহিনী আছে।

১০০ বছর আগে একইভাবে ‘যুদ্ধবাজ নেতাদের’ হানাহানিতে চীন সামরিকভাবে ভেতরে ভেতরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংহতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে এখন যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তার পেছনে সেই ১০০ বছর আগের সমন্বিত স্মৃতি বড় ধরনের কাজ করে।

আজও, গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ৭৫ বছর পরও সেনা–সমর্থিত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের চিন্তা চীনা নেতৃত্বের মধ্যে কাঁপুনির সৃষ্টি করে। ব্যাপকভাবে একটি গুঞ্জন চালু আছে, ২০১২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতা বো শিলাই ক্ষমতা দখল করতে দুর্বৃত্ত সেনা নেতাদের সঙ্গে চক্রান্ত করেছিলেন। তবে ক্ষমতায় বসার পরপরই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিশ্চিত করেন, পিএলএ দৃঢ়ভাবে পার্টির নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপরই তিনি সেনাবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালান এবং অসংখ্য জেনারেলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন

১৯১১ সালে একটি অপরিকল্পিত বিপ্লবী জোট চীনের শেষ সম্রাটকে (আনুষ্ঠানিক সম্রাট পদে তখন একটি পাঁচ বছরের বালক আসীন ছিল) ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তারা এশিয়ায় প্রথম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

নতুন এই রাষ্ট্র তখন খুবই অস্থিতিশীল ছিল। রাষ্ট্রটির সাংবিধানিক প্রেসিডেন্ট সান ইয়াৎ-সেন মাত্র সপ্তাহ কয়েক গদিতে ছিলেন। ওই সময় ইউয়ান শিকাই নামের এক সেনা অধিনায়ক ছিলেন, যাঁর অধীনে বিশালসংখ্যক সেনা ছিল। সেই সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নয়, বরং ইউয়ান শিকাইয়ের অনুগত ছিল। এই বাহিনীর জোরে ইউয়ান শিকাই জোর করে সান ইয়াৎ-সেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

সামরিক গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যে হানাহানির কারণে চীনের সংক্ষিপ্ত আয়ুর প্রজাতান্ত্রিক সরকারের মৃত্যু ঘটেছিল। ইউয়ান নিজেকে চীনের নতুন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা করার কিছুদিনের মধ্যেই (১৯১৬ সালে) মারা যান। এর পরবর্তী দেড় দশক চীন কার্যত স্থানীয় সামরিক যোদ্ধাদের গ্রুপগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসন বলতে কার্যত তখন কিছু ছিল না।

সে সময় ‘জুনফা’ বা ‘যুদ্ধবাজ’ শব্দটি তাদের সেনা কমান্ডারদের নিন্দনীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। সে সময় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীরা আক্ষেপ করে বলতেন, বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ভেতরের যুদ্ধবাজি প্রবণতা চীনের বিপদকে দ্বিগুণ করে তুলেছে।

চীনের এই বিভক্ত কর্তৃত্বের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট ও ভয়ানক। কোনো শাসকই নিজেকে গোটা চীনের শাসক বলে দাবি করতে পারছিলেন না এবং সামরিক কমান্ডাররা নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ার কারণে একেক সময় একেক দলে বিভক্ত হয়ে হানাহানি করছিলেন। এতে বাহিনীগুলোর আন্তসম্পর্ক ভেঙে পড়ছিল।

এসব যুদ্ধবাজ নেতা কর আদায়ের উৎসগুলোর দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। নৌ শুল্ক পরিষেবার মতো খাত বিদেশিরা চালাচ্ছিলেন; বিনিময়ে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ যখন যে যুদ্ধবাজ নেতার হাতে থাকছিল, তখন তাঁরা সেই নেতাকে রাজস্ব দিচ্ছিলেন। মোদ্দা কথা, সাংবিধানিক সরকার তখন পুরোদস্তুর অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।

চলতি বছরের আসন্ন শরতে ১৯২৩ সালের চীনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শতবর্ষ পূরণ হবে। সেই নির্বাচনে কাও কুন নামের এক যুদ্ধবাজ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ঘুষ দিয়ে ‘জিতেছিলেন’।

তবে ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, সব যুদ্ধবাজ নেতাই পুরোপুরি খারাপ মানুষ ছিলেন না। চীনে মেয়েদের পায়ের আকার ছোট রাখতে ছোটবেলায় পায়ে লোহার জুতো পরানো হতো বা পা বেঁধে রাখা হতো। শাংঝি প্রদেশের যুদ্ধবাজ নেতা ইয়ান জি শান এই অমানবিক রীতি নিষিদ্ধ করার মতো বেশ কিছু সামাজিক সংস্কারমুখী কাজ করে ইতিহাসে প্রশংসিত হয়েছেন।

চীনে এই দুর্বল সরকার ব্যবস্থা কারও কারও জন্য আশীর্বাদের বিষয় ছিল। কারণ এ অবস্থায় কমিউনিস্ট ও লেখকদের মতো রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী মানুষেরা কোনো এক অঞ্চলের কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হলে তাঁরা পালিয়ে সেই কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিপক্ষের আশ্রয়ে চলে যেতে পারতেন।

চীনের এই সমস্যার শুরুটা ছিল ১৯১১ সালের বিপ্লবের অর্ধশতাব্দী আগে। ১৮৫০ ও ১৮৬৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পূর্ব চীনে তাইপিং বিদ্রোহীরা একটি নৃশংস গৃহযুদ্ধে গণহত্যা চালান। ওই সময় কিং রাজবংশ সেই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল।

তবে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও রাজকীয় বাহিনী তাইপিং বিদ্রোহীদের বাগে আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সম্রাটকে বাধ্য হয়ে প্রাদেশিক নেতাদের নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তাইপিং বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করার অনুমতি দিতে হয়। এর ফলে প্রাদেশিক নেতারা নিজস্ব সেনাবাহিনী বড় করার সুযোগ পেয়ে যান। সম্রাটের এই কৌশল সফল হয়েছিল; তাইপিংদের দমনও করা গিয়েছিল। তবে সেটি করতে হয়েছিল কেন্দ্রের হাত থেকে প্রদেশগুলোয় সামরিক শক্তি হস্তান্তরের বিনিময়ে। এরপর রাজবংশ দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সামরিক নেতারা শক্তিধর হয়ে ওঠেন। শেষ সম্রাটের পতনের পর এই প্রাদেশিক শাসকেরাই সামরিকবাদী ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

১৯২৮ সালে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই-শেক যে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা চীনকে নামমাত্রে একীভূত করেছিল। তিনি পরবর্তী ১০ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক নেতাদের পাশাপাশি কমিউনিস্টদের সঙ্গে লড়াই করে কাটিয়েছিলেন।

১৯৩৭ সালে জাপানের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধবাজ নেতারা তাঁদের আঞ্চলিক শক্তি ধরে রাখতে আক্রমণকারীদের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি ছিন্ন করেন। এই যুদ্ধ সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টিকেও নতুন শক্তি দেয়। পার্টির উদীয়মান নেতা মাও সেতুং এ সময় ঘোষণা দেন, ‘বন্দুকের নল থেকেই ক্ষমতা বিকশিত হয়’। উপসংহারে তিনি বলেন, ‘দল বন্দুককে আদেশ করে; বন্দুককে কখনোই দলকে আদেশ করতে দিতে নেই।’

মাও তাঁর কথার মতোই দৃঢ় ছিলেন। কমিউনিস্টরা ১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করলে মাও চীনে ক্ষমতার সম্ভাব্য সব বিকল্প উৎসকে চূর্ণ করা শুরু করেন। পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) তিনি পার্টির সেনাবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, জাতীয় সেনাবাহিনী হিসেবে নয়। আজও চীনের সেনাবাহিনী সেই মর্যাদায়ই টিকে আছে।

এমনকি আজও, গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ৭৫ বছর পরও সেনা–সমর্থিত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের চিন্তা চীনা নেতৃত্বের মধ্যে কাঁপুনির সৃষ্টি করে। ব্যাপকভাবে একটি গুঞ্জন চালু আছে, ২০১২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতা বো শিলাই ক্ষমতা দখল করতে দুর্বৃত্ত সেনা নেতাদের সঙ্গে চক্রান্ত করেছিলেন।

তবে ক্ষমতায় বসার পরপরই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিশ্চিত করেন, পিএলএ দৃঢ়ভাবে পার্টির নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপরই তিনি সেনাবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালান এবং অসংখ্য জেনারেলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন।

চলতি সপ্তাহে যখন রাশিয়ার একটি বড় শহর পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী সেনাবাহিনীর দখলে যাওয়ার খবর বের হয়, তখন নিঃসন্দেহে চীনা পলিটব্যুরোর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ তারা জানে যে সামরিক বিষয়ে তাঁরা যেসব নির্মমতা দেখিয়েছে, তার মূল্য অনেক চড়া।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • রানা মিত্তার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আধুনিক চীনের ইতিহাস ও রাজনীতি’ বিষয়ের অধ্যাপক এবং সম্প্রতি প্রকাশিত ‘চায়নাস গুড ওয়ার: হাউ ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু ইজ শেপিং আ নিউ ন্যাশনালিজম’ বইয়ের লেখক।