দাকোপে যেতে এখনো বরনপাড়া-পানখালী ফেরি পার হতে হয়। সিডরের সময় থেকেই ঝপঝপিয়া নদীর ওপর সেতু হওয়ার আলাপ শুনছি। এর মধ্যে দেশ অনেক দূর এগোলেও সেতু আর হয়নি।
ফেরির ইঞ্জিনঘরের উল্টো দিকে কানাই মণ্ডল ঠিক আগের মতোই বসে ছিলেন সামান্য কিছু মৌসুমি ফল নিয়ে। এক ঝুড়ি গবেদা আর গোটা চারেক বেল। পানখালী ইউনিয়নের তিতাপালিতে কানাই মণ্ডলের বাড়ি। সিডরে জাল-নৌকা হারিয়ে সেই যে তিনি পেশা হারিয়েছেন, আর ফিরে পাননি।
জাল-নৌকার আশ্বাস মিলেছিল অনেক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর মেলেনি। জলদাস কানাই মণ্ডল জীবনকে টেনে নেওয়ার জন্য ভাটার দাস হয়েছিলেন। কুমিল্লা, ভোলাসহ দেশের আনাচকানাচে ইটভাটায় কাজ করেছেন বছর কয়েক। এখন আর তাঁকে ডাকেন না সরদারেরা।
গত বছর তাঁর চোখের ছানি কাটার কথা ছিল। ‘ফ্রি চক্ষু ক্যাম্প’-এ নামটাম লিখে নিয়েছিল, তারপর আর খবর দেয়নি। আগামী শীতে নাকি ডাকবে। মণ্ডলবাবু আমাকে তাঁর ছানি পড়া চোখে প্রথমে ঠিক চিনতে পারেননি। বেলের দাম মেটানোর সময় গলার আওয়াজে চিনে ফেলেন। বলেছিলাম, বেল এত হালকা কেন?
সিডরের পরের বছর এই ফেরিঘাটেই আমাকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে বেল, কাঁঠাল, তরমুজ, পেঁপে কিনলে ঠকার আশঙ্কা থাকে না। বলেছিলেন, ওজন দেখে মাল কিনতে হয়, রংটং দেখে নয়। সেই নির্দেশ অনুসরণ করে কালে কালে আমি ফল কিনতে ওস্তাদ হয়ে উঠি।
কানাই মণ্ডলের সেসব তালিমের কথা মনে পড়েই হোক আর আমার আওয়াজ উচ্চারণেই হোক, আমাকে চিনে ফেলে হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুমি বেল নিয়ো না। সব শুকিয়ে গিয়েছে, রসকষ নেই বেলের মধ্যে, রস পাবে কোথা থেকে? জল যে নেই মাটির নিচে। সবকিছুতেই আমাদের কষ্ট। তবে পানির কষ্টটা আর গেল না। আশপাশের সব পানিতে লবণ।’
ততক্ষণে ফেরি পৌঁছে গেছে ঘাটে। আমি বেল নিয়ে নেমে পড়ি। কানাই মণ্ডলের কথা ঠিক ঠিক ফলে যায়। বেলগুলোর ভেতর একদম শুকনা পাউডারের মতো।
ভোরের আলো দেখা দেওয়ার আগে থেকেই এখানকার মানুষ শুরু করে পানীয় জল সংগ্রহ আর সংরক্ষণের কাজ, মাঝরাত পর্যন্ত চলে সেই অভিযান। পানি সংগ্রহের যুদ্ধ চলে সারা দিন। কর্মঘণ্টা আর দাম হিসাব করলে মোট আয়ের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ চলে যাচ্ছে পানির পেছনে।
দাকোপ এলাকায় নলকূপ চলে না। মানুষ আগে বড় বড় মাটির পাত্রে (মটকা) বর্ষার জল ধরে রাখত। বৃষ্টির পানি জমে থাকা পুকুরের পানিও খাওয়া যেত। গোসল, রান্নাবান্নার কাজও চলত। আজ থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার দাপটে বেড়িবাঁধ ভেঙে এই অঞ্চল লবণপানিতে ডুবে থাকে অনেক দিন।
আইলার পর থেকে ভূপৃষ্ঠের ওপরের পানির সবটাই প্রবলভাবে লবণাক্ত হয়ে যায়। আগের মতো মিষ্টিপানি আর কোথাও মেলে না। তারপরও চলছিল কোনোমতে। কিন্তু এবারের গরমে লবণাক্ততা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
‘কষ্টের কোনো শেষ নেই’ জানালেন এক উন্নয়নকর্মী। তাঁদের সংগঠন পানি থেকে লবণ বিযুক্ত করে পানের উপযোগী করে বিক্রি করে। লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্ট (রিভার্স অসমোসিস প্ল্যান্ট) পর্যন্ত কেউ এলে তাঁকে এক গ্লাস পানি ফ্রি দেওয়া হয় কিন্তু বাড়ির জন্য নিতে হলে প্রতি লিটারে এক টাকা দিতে হয়।
বছর পাঁচেক আগে শরণখোলায় এ রকম এক প্ল্যান্টে প্রতি লিটার ২৫ পয়সা নেওয়া হতো। এখন তারা নিচ্ছে ৭৫ পয়সা। দাকোপ বাজারে ২০ লিটারের পানি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। ভ্যানচালকদের অনেকেই আর ভ্যানে মানুষ বা মাল না টেনে বাড়ি বাড়ি বা দোকানে, রেস্তোরাঁয় পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।
চীনের তৈরি পানি থেকে লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলো এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন এই খাতে অর্থ লগ্নি করছেন। ক্রমে পানির ব্যবসা জমে উঠছে আর মানুষ পানি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের বেঁধে দেওয়া দামে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে এখানে পানির দাম বাড়ে। সরকার ইচ্ছা করলেই লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলোর জন্য বিদ্যুতের অন্য দাম রাখতে পারে। দামের কারণে মানুষ নিরাপদ পানি পান কমিয়ে দিলে চাপ বাড়বে স্বাস্থ্য খাতে।
চীনের তৈরি পানি থেকে লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলো এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন এই খাতে অর্থ লগ্নি করছেন। ক্রমে পানির ব্যবসা জমে উঠছে আর মানুষ পানি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের বেঁধে দেওয়া দামে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে এখানে পানির দাম বাড়ে। সরকার ইচ্ছা করলেই লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলোর জন্য বিদ্যুতের অন্য দাম রাখতে পারে। দামের কারণে মানুষ নিরাপদ পানি পান কমিয়ে দিলে চাপ বাড়বে স্বাস্থ্য খাতে।
এলাকায় হাঁটলেই সেসব স্বাস্থ্যসংকটের আলামত খালি চোখেই নজরে আসে। কথা ছিল, লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলো ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করবে কিন্তু ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থে অনেকেই নদী-নালা, খাল-বিলের পাশাপাশি দ্বিতীয় উৎসের ব্যবস্থা রাখছে। গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের পানি অনেকে এস্তেমাল করছে। এটা এলাকার পানির পরিবেশকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলছে। এ কারণেই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল আর আগের মতো সতেজ, সরস থাকছে না।
লবণ বিযুক্তকরণ প্ল্যান্টগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো নির্দিষ্ট প্রটোকল বা বিধান নেই। যে যেখানে যেভাবে পারছে বর্জ্য ফেলে দিচ্ছে বা ফিরিয়ে দিচ্ছে জলাধারে।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখা বা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ছিল এই এলাকার পানি নিরাপত্তার প্রাচীন কৌশল। ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ উন্মুক্ত স্থানে (পুকুর, দিঘি ইত্যাদি) বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে জনগণকে আর উৎসাহিত করে না। আইলার পর থেকে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণপানি ঢুকে যাওয়ার ঘটনা আকছার ঘটছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রেও কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
সিডর ও আইলা-পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনে মানুষের গমনাগমনের ওপর বিধিনিষেধ জারি করলে গোলপাতা ক্রমে দুর্লভ হয়ে ওঠে এবং মানুষ ঘরের ছাউনি হিসেবে অ্যাসবেসটস শিট ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমরা জানি, অ্যাসবেসটস মানবদেহে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ফলে অ্যাসবেসটস শিট বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির পানি কতটুকু নিরাপদ, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কোনো বিকল্প নেই।
এই প্রক্রিয়ায় পুকুর বা জলাশয়ের পানিকে খোয়া, বালু ও চারকোলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এটি বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি উপকূলীয় পানি ব্যবস্থাপনা। তবে শক্ত সামাজিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে এটা সফল হয় না। সিডর ও আইলার পর অনেক সংস্থা স্থানীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুলেই শত শত পিএসএফ তৈরি করে বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে।
শরণখোলার রায়েন্দা প্রতিষ্ঠিত একটি পিএসএফ ২০০৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর ধরে প্রায় ৫০০ পরিবারের নিরাপদ পানির সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সফল সামাজিক ব্যবস্থাপনার এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
টেকসই ও সাশ্রয়ী পানি ব্যবস্থাপনার রহস্য লুকিয়ে আছে সামাজিক মালিকানার মধ্যে। সমাজের সম্পৃক্ততা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিবেশ আমাদের তৈরি করতে হবে। থাকতে হবে জবাবদিহি। শরণখোলার রায়েন্দার মানুষ পারলে অন্যরা পারবে না কেন?
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com