প্রচলিত পেনশন বন্ধ না করে দুর্নীতি ও চুরি রোধ করুন

প্রাসঙ্গিকভাবেই ব্যক্তিগত কিছু কথা প্রথমে চলে আসছে। বুয়েটে আমার স্নাতকের শেষ টার্মের পরীক্ষা সমাপ্তি ও ফলাফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম বেশ কয়েক মাস আগে থেকে। কারণ, এটা সম্পন্ন হলেই পিএইচডি শুরু করতে সিঙ্গাপুর চলে যাব, স্কলারশিপসহ অফার চূড়ান্ত।

আমরা বুয়েট কেমিকৌশল বিভাগ থেকে পাঁচজন একত্রে। সঙ্গে অন্যান্য বিভাগ থেকেও কয়েকজন ছিল। আমাদের স্নাতক ব্যাচ থেকে আমরাই প্রথম পিএইচডির জন্য যাত্রা শুরু করি। আবার পিএইচডির শেষ বর্ষের শুরুতেই ক্যারিয়ারের পরবর্তী ধাপ নিয়ে পরিকল্পনা করি।

পিএইচডি থিসিস আনুষ্ঠানিকভাবে জমাদানের ঠিক আগে সৌদি আরবের দুটি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর (রিসার্চ) পদে যোগদানের অফার পাই। তাদের অফারে সুযোগ-সুবিধা আমার জন্য খুব যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ছিল। আনন্দিতও ছিলাম। সমসময়ে বুয়েটে আমার নিজ বিভাগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

আমি বিভাগে যোগদান করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে কর্তৃপক্ষ ইতিবাচকভাবে তা গ্রহণ করে। বুয়েটে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া অনুযায়ী নিজ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হলাম ২০১১-এর আগস্ট মাসে। সরকারি বেতন-ভাতা কী হবে বা এটা পর্যাপ্ত কি না, তা একেবারেই ভেবে দেখিনি। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশকে সেবা দেব, এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিবেচনা ছিল।

আমার বাড়ি ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকেই বাসে যাওয়া-আসা করে বুয়েটে নিয়মিত দায়িত্ব পালন শুরু করি, যা একসময়ে কঠিন হয়ে যায়। বুয়েট শিক্ষক আবাসিক কোয়ার্টারেও বাসা পাওয়া সম্ভব হয়নি তখন। বাধ্য হয়ে পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিলাম। একটি নিরাপদ ও মানসম্পন্ন বাসস্থান প্রতিটি পেশাজীবীর মৌলিক অধিকার ও চাওয়া। সেভাবেই নিলাম।

শিক্ষক হিসেবে আমার বুয়েটে তখন যে বেতন ছিল, তা সেই বাসার ভাড়া, ইউটিলিটি ও সার্ভিস চার্জ থেকেও কম। পিএইচডির স্কলারশিপ থেকে যা সঞ্চয় করেছি, তা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে যা লভ্যাংশ পেতাম, তা খরচ করে পরিবার নিয়ে চলতে হতো। ২০১২ সালের কথা। কী এক বেতনকাঠামো ছিল! যা-ই হোক, নিজের অর্থ ব্যয় করেও কেন এই পেশায় ছিলাম? উত্তরে বলব, জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টির সুযোগ, দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নের সুযোগ, রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজের চিন্তা উপস্থাপনের সুযোগ ও একটি স্বাধীন-সৌহার্দ্যপূর্ণ-সুশৃঙ্খল কর্মপরিবেশ। এটাই ছিল মূল প্রেরণা।

২০১২ সালের শেষের দিকে শিক্ষক আবাসিক কোয়ার্টারে বাসা পেলাম। সঙ্গে বুয়েটের নিজস্ব উৎস থেকে আয় বাড়ল। এগিয়ে যেতে থাকলাম। ২০১৫ সালে গতানুগতিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ সরকার একটি মহৎ, যথার্থ ও মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চতর জাতীয় বেতনকাঠামোর কথা ঘোষণা করল। সরকারের লক্ষ্য ছিল, জাতীয় বেতনকাঠামোভুক্ত সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করে নিজ নিজ কর্মে সম্পূর্ণভাবে মনোযোগী ও নিবেদিত করা।

সবাই স্বাগত জানিয়ে আনন্দের সঙ্গে নতুন বেতনকাঠামো গ্রহণ করলেন। জাতীয় বেতনকাঠামোর অংশীজন হিসেবে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তা স্বাগত জানান।

তবে প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কূটকৌশলজনিত এক বৈষম্য। সিলেকশন গ্রেড বাতিলের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় বেতনকাঠামোর গ্রেড-১ থেকে অবনমন করে গ্রেড-৩ ধাপে সীমাবদ্ধ করা হলো। অপর দিকে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য গ্রেড-১ ধাপের ওপরে একটি সুপারগ্রেড আনা হলো। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিন ধাপ অবনমন করার চেষ্টা চলে প্রথমে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, সব ক্রান্তিকালে এ দেশের শিক্ষকসমাজ ভূমিকা রেখেছে। অন্যায়, বৈষম্য ও কূটকৌশল বোঝার ক্ষমতা এবং প্রতিবাদের ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজের রয়েছে।

আমরা ন্যায্য দাবি নিয়ে ২০১৫ সালের উচ্চতর বেতনকাঠামোর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তা ও মধ্যস্থতায় সমস্যার একটি সমাধান হয়। আমাদের জন্য আগের মতো বেতনকাঠামোর গ্রেড-১ ধাপে পৌঁছার পথ সক্রিয় করা হয়। তবে গ্রেড-২ ও গ্রেড-১ ধাপে পৌঁছার জন্য নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়। যাহোক, বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো শর্তেই শিক্ষকসমাজ শঙ্কিত নয়। তবে সরকারের প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেড পাওয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ আজও বঞ্চিত, যা অসাংবিধানিক। এই অসাংবিধানিক বৈষম্যের অবসান হওয়া জরুরি।

এ দেশের বিচার বিভাগীয় জেলাপর্যায়ের সম্মানিত বিচারকেরাও দীর্ঘদিন একধরনের বৈষম্যের মধ্যে ছিলেন। বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অবশেষে তাঁরা সমাধান পেয়েছেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনে একটি উপযুক্ত দৃষ্টান্ত হতে পারে।

শিক্ষকদের পেনশনে আসা যাক। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রয়োজনীয় অর্থ আসে সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে। শিক্ষকের জাতীয় বেতনকাঠামো অনুসারে বেতন-ভাতা পান নিয়মিতভাবে। আর অবসরে গেলে পান পেনশন।

অবসর-পূর্ববর্তী বেতন-ভাতা এবং অবসর-পরবর্তী পেনশন—দুটি মিলিয়ে একটি প্যাকেজ চিন্তা করা যায়, যা একজন শিক্ষকের পেশাগত প্রাপ্তি। একটি বিষয় সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান নিয়মানুযায়ী, পেনশন কোনো অনুদান বা সহায়তা নয়, এটি শিক্ষকদের পেশাগত পাওনা, তাঁদের সেবার বিনিময় মূল্য, তাঁদের পারিশ্রমিক।

শিক্ষকদের প্রচলিত পেনশনের যৌক্তিকতা তুলে ধরা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে, বেসরকারি খাতে কর্মরত আমার সহপাঠীদের কথা চিন্তা করা যাক।

বেসরকারি খাতে তাঁরা নিয়মিতভাবে যে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তা নিঃসন্দেহে নিশ্চিতভাবে সর্বদা আমাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা থেকে বেশি। এই ‘বেশি’র পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের বেতন-ভাতার কয়েক গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কর্মজীবন শেষের দিকের এই ব্যবধান অনেক বেশি হয়।

কাজেই বেসরকারি খাতের একজন পেশাজীবী তাঁর নিয়মিতভাবে প্রাপ্ত বেতন-ভাতার অধিকতর অংশ সঞ্চয়ের মাধ্যমে, অবসর-পরবর্তী সময়ের জন্য আমাদের পেনশনের চেয়েও অধিকতর আর্থিক সুরক্ষা পেতে পারেন।

আরও উল্লেখ্য, অধিকতর বেতন-ভাতার পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও এখন বিভিন্ন অবসর-সুবিধা বিদ্যমান। শিক্ষকদের কাজের পরিধি ও সময়কাল অন্যদের তুলনায় বেশি ছাড়া কোনো অংশে কম নয়। সুতরাং শিক্ষকদের প্রচলিত পেনশন একটি ন্যায্য ও যৌক্তিক পাওনা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, জাতীয় বেতনকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত যাঁরা পেনশন পাচ্ছেন, তা তাঁদের সেবার বিনিময়ে ন্যায্যভাবেই পাচ্ছেন। সরকারও সেই হিসাবে বাজেট প্রণয়ন করে চলেছে।

সাম্প্রতিক সর্বজনীন পেনশন প্রসঙ্গ। নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য নতুন ধারার সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা ঘোষণা করেন। এই পেনশনব্যবস্থা পেশাজীবীদের জন্য প্রচলিত সরকারি পেনশন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নীতিগতভাবে সর্বজনীন পেনশন ও পেশাজীবীদের জন্য সরকারি পেনশন—দুটি পৃথক বিষয়। একটি নাগরিক সুরক্ষা, অপরটি সরকারি পেশাজীবী সুরক্ষা।

প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন যে যাঁরা সরকারি পেনশন পান না, তাঁদের ভবিষ্যৎ আর্থিক সুরক্ষার জন্য এই সর্বজনীন পেনশন। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের আরও একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু এটি পেশাজীবীর জন্য বাধ্যতামূলক করার আইনগত সুযোগ আছে কি না, তা দেখার বিষয়। সরকার কি কোনো পেশাজীবীর জন্য এটা বাধ্যতামূলকভাবে চেয়েছিল? না, সরকারের এই অবস্থান কিন্তু খুব স্পষ্ট ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে, আসল উদ্দেশ্যের বাইরে গিয়ে, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ‘প্রত্যয়’ নামের একটি নতুন সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ নিয়ে এল। এখানে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর কর্মজীবীদের বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়, যেখানে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত সরকারি পেনশনব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই স্কিমে যুক্ত করা হলো।

২০২৪ সালের ১৩ মার্চ প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর, প্রচলিত সরকারি পেনশন এবং নতুন প্রত্যয় স্কিম তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বুঝতে পারলেন, এই নতুন স্কিম শিক্ষকদের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয়, বরং সমগ্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ধ্বংসাত্মক। গাণিতিক গণনা ও বিশ্লেষণ হাতে নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল রেখে, নিজ নিজ দায়িত্ব চালিয়ে গিয়ে শিক্ষকেরা নানাভাবে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে এই প্রত্যয় স্কিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন।

একপর্যায়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই স্কিম কার্যকর হবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রত্যয় স্কিম, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যমূলক হয়ে ওঠে। যেমন ২০২৪ সালের ১ জুলাই পুরোনো একজন শিক্ষক গ্রেড-১ অধ্যাপক হিসেবে যদি অবসরে যান, তাহলে সে এককালীন পাবেন ৮০ দশমিক ৭৫ লক্ষ টাকা এবং মাসিক ৩৫ হাজার ১০০ টাকা হারে প্রতি মাসে পেনশন পাবেন। মাসিক ৩৫ হাজার ১০০ টাকা আবার ৫% হারে বছর বছর বৃদ্ধি পাবে। এই মাসিক টাকা পেনশনভোগী আমৃত্যু পাবেন। তাঁর মৃত্যুর পর নির্ভরশীল স্ত্রী বা স্বামীও আমৃত্যু পাবেন।

অপর দিকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই যোগদান করা একজন নতুন শিক্ষক তাঁর সম্পূর্ণ কর্মজীবনে মাসে মাসে নিয়মিতভাবে বেতন থেকে একটি অংশ প্রত্যয় স্কিমে জমা দিয়ে আজ থেকে ৩৫ বছর পর যদি গ্রেড-১ অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান, তিনি এককালীন কোনো অর্থই পাবেন না, শুধু মাসিক ১ দশমিক ২৪ লাখ টাকা করে সমহারে প্রতি মাসে পেনশন পাবেন। এখন প্রচলিত পেনশনের এককালীন ৮০ দশমিক ৭৫ লাখ টাকা একেবারে বিবেচনার বাইরে রাখি।

প্রচলিত পেনশনব্যবস্থার আজকের মাসিক ৩৫ হাজার ১০০ টাকা ৫% বাৎসরিক হারে বৃদ্ধি পেলে ৩৫ বছর পর এর মূল্য হবে মাসিক ১ দশমিক ৯৪ লাখ টাকা, যা প্রত্যয়ের ১ দশমিক ২৪ লাখ থেকে বেশি। অপর দিকে প্রত্যয়ের ৩৫ বছর পরের মাসিক ১ দশমিক ২৪ লাখকে বাংলাদেশের স্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি ৭% ধরে বর্তমান সময়ে নিয়ে এলে তা হয় মাত্র ১১ দশমিক ৬ হাজার টাকা, যা প্রচলিত পেনশনের বর্তমান মাসিক ৩৫ হাজার ১০০ টাকা থেকে অনেক কম।

এসব যৌক্তিক গাণিতিক গণনা ও বিশ্লেষণ থেকে যেকোনো সচেতন মানুষ বুঝতে সক্ষম হবেন যে নতুন প্রত্যয় স্কিম থেকে প্রচলিত পেনশন অনেক ভালো। বর্তমানের শিক্ষকেরা প্রত্যয় স্কিম থেকে মুক্তি পেলেও ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া নতুন শিক্ষকেরা বঞ্চিত হবেন। যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবীরা ভবিষ্যতে এই পেশায় আসতে আগ্রহ হারাবেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সমগ্র উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। দক্ষ জনশক্তির অভাবে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যাশা ব্যর্থ হবে। কাজেই সমগ্র উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ও স্মার্ট বাংলাদেশ এর স্বার্থে, নৈতিক অবস্থান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চলমান এই আন্দোলন।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে সরকার। বছর বছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নীতি অনুযায়ী, এই পরিস্থিতিতে জাতীয় বেতনকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত সবার বেতন-ভাতা বাড়ার কথা। নতুন উচ্চতর বেতনকাঠামো ঘোষণার কথা। অথচ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কেন এই বিপরীত অবস্থান? যা সরাসরি রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, দেশের আর্থিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো চেষ্টা চলমান কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, প্রচলিত পেনশন বন্ধ নয়, দেশের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রথম প্রয়োজন দুর্নীতি বন্ধ করা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বিরাজমান। সর্বক্ষেত্রে সব পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

গণমাধ্যমের কল্যাণে কয়েক দিন আগে দেখলাম, দেশের বেসরকারি খাতের একটি শিল্পগোষ্ঠীর মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের তিন বছরে ভ্যাট ফাঁকি প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতের আয়কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে। রিজার্ভ চুরি হয়ে যাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের হাজারো কোটি টাকার অবৈধ অর্থ-সম্পদের সংবাদ আসছে নিয়মিত। অপব্যয় ও অপচয় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। সব পর্যায়ে অপচয়, অপব্যয় ও দুর্নীতি বন্ধ করা হোক, দেশের আর্থিক সক্ষমতা উজ্জ্বলতার সঙ্গে দৃশ্যমান হবে।

দার্শনিক প্লেটোর মতে, নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব যথার্থভাবে সুসম্পন্ন করা একটি উৎকৃষ্ট পর্যায়ের দেশপ্রেম। আমরা ডিগ্রিধারী হয়েছি, পেশাজীবী হয়েছি, কিন্তু এখনো অনেকেই উৎকৃষ্ট দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারিনি। পেশাজীবীদের ধ্যান, জ্ঞান, শ্রম ও ব্যস্ততা সবকিছুই থাকতে হবে নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্বকে ঘিরে। সততা থাকতে হবে সর্বক্ষণে। রাষ্ট্রের স্বার্থ থাকতে হবে সর্ববিবেচনায়। এ বিষয়ে আমাদের অধিকতর মনোযোগী হতে হবে।

আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন। নিজেরদের শূন্যতা ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে যেতে আমরা সর্বদা সচেষ্ট। গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথার্থ বেতন-ভাতা এবং ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকতে চাই। পরিশেষে বলব, শিক্ষকদের প্রচলিত পেনশন বন্ধ নয়, সর্বক্ষেত্রে সব পর্যায়ে অপচয়, অপব্যয় ও দুর্নীতি বন্ধ করুন, রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। সরকারের ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভবপর হবে।

  • মো. ইকবাল হোসেন অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট।

iqbalhossain@che.buet.ac.bd