আমরা আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করছি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায় বিভিন্ন প্রার্থীর হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের নানা বিশ্লেষণ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৫ সালে বিচারপতি এম এ মতিনের নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হলফনামার মাধ্যমে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা; অতীতের ও বর্তমান মামলার বিবরণী; নিজেদের ও নির্ভরশীলদের আয়, সম্পদ, দায়-দেনাসহ আট ধরনের তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেন। একই সঙ্গে আদালত নির্বাচন কমিশনকে এসব তথ্য জনগণের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশনা প্রদান করেন, যাতে তাঁরা জেনে-শুনে-বুঝে পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন [আবদুল মতিন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ, ৬৬ডিএলআর (২০০৪)]।
নির্বাচন কমিশন আদালতের নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হলেও আমরা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পক্ষ থেকে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্যের ভিত্তিতে আসনভিত্তিক তুলনামূলক চিত্র তৈরি করে ২০০৫ সাল থেকে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করে আসছি। এসব তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমরা এ পর্যন্ত গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের জন্য তিনটি বড় ভলিউম প্রকাশ করেছি। নির্বাচনসংক্রান্ত আরও অনেক তথ্য আমরা সুজনের ওয়েবসাইটে (www.votebd.org) প্রকাশ করেছি।
পাশাপাশি আমরা গণমাধ্যমকে এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থীদের সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করে জনগণকে সচেতন করতে উদ্বুদ্ধ করে আসছি। আমরা আনন্দিত যে গণমাধ্যম এসব তথ্য ব্যবহার করে হলফনামায় নানা অসংগতি তুলে ধরছে। প্রসঙ্গত, আমাদের প্রচেষ্টায় হলফনামার ভিত্তিতে তথ্য প্রদানের বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া সব কটি স্থানীয় সরকার আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে এক দুর্বৃত্তকে ব্যবহার করে আদালতের মাধ্যমে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই বিধানকে ভন্ডুল করার প্রচেষ্টা।
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের একটি ইতিহাস রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম এডিআর [(২০০২)৫এসসিসি] মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ২০০২ সালে দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদে (বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে) বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট প্রদান ভোটারের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ ভোটার মতপ্রকাশ বা বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোট প্রদানের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি। গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্য এমপি ও এমএলএ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর অতীত, তাঁদের অপরাধসংক্রান্ত অতীতসহ অন্যান্য তথ্য ভোটারদের জানা অতি প্রয়োজন। ফলে ক্ষুদ্র ব্যক্তিটিও একজন আইনভঙ্গকারীকে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত করবেন কি না, তা আগেই বিবেচনায় আনতে পারেন।’ প্রসঙ্গত, বাক্স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি আইন করেও রহিত করা যায় না।
পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(২০০৩)৪এসসিসি] মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেন, ‘এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানেন। তাঁদের “এ” কিংবা “বি”-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র ও উপহাসে বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ অর্থাৎ নির্বাচনকে কলুষমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার লক্ষ্যেই প্রার্থীদের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আমাদের উচ্চ আদালতের রায় এসেছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ দুটি রায়ের ধারাবাহিকতায়।
হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের পক্ষে জোরালো যৌক্তিকতা থাকলেও এ প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করার বহু প্রচেষ্টা অতীতে আমাদের দেশে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালের খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা সুজনের উদ্যোগে ২০০৭ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে নির্বাচিত মেয়রদের—যাঁদের সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়—আয় ও নিজেদের ও নির্ভরশীলদের সম্পদ আকাশচুম্বী হয়েছে, অর্থাৎ নির্বাচনে জয়ের সঙ্গে সোনার কাঠি জড়িত। পক্ষান্তরে বিএনপি-মনোনীত প্রার্থীদের—একই প্রার্থীরা দুই নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন—আয় ও সম্পদের পরিমাণ হয় একই পর্যায়ে ছিল অথবা কমেছে।
নির্বাচিত মেয়রদের আয় ও সম্পদের উল্লম্ফনের তথ্য একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশের পর ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় যে আমরা মনগড়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের প্রার্থীদের মর্যাদাহানি করেছি। (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০১৪)।
অথচ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার দাবি ছিল আওয়ামী লীগেরই এবং দলটি একাধিকবার সম্পদের হিসাব প্রদানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও করেছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীনেরা একাধিকবার ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদানের ও প্রকাশের অঙ্গীকার করলেও তা রক্ষা করা হয়নি।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা না করার কারণে বর্তমানে আমরা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণে এক বিরাট উল্লম্ফন দেখতে পাচ্ছি। তবে হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, হলফনামায় অন্তত সাতজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের নির্ভরশীলদের তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে (আজকের পত্রিকা, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩)।
শুধু সম্পদের হিসাবই নয়, অনেক প্রার্থী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও গোপন করেছেন। যেমন সম্প্রতি বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর সম্পদের হিসাবের পাশাপাশি মামলার তথ্যও গোপন করেছেন, যে মামলায় জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি জার্সি বদল করেছেন।
শুধু সরকারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গই নয়, নির্বাচন কমিশনের তথ্য যাচাই-বাছাই করার, এমনকি তথ্য প্রকাশের, বিশেষত আয়কর বিবরণী প্রকাশের ক্ষেত্রে অনাগ্রহও হলফনামায় তথ্য গোপনের অন্যতম কারণ। সুজনের পক্ষ থেকে বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তথ্য যাচাই করার ব্যাপারে কমিশনের কোনো সাড়া আমরা পাইনি।
এটি কারও অজানা নয় যে দুর্নীতি ঘটে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে, আর দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নই জাতি হিসেবে আমাদের পেছনে টেনে রেখেছে। আমাদের দেশে রাজনীতির ‘দুর্নীতিকরণ’ ও দুর্নীতির ‘রাজনৈতিকীকরণ’ বর্তমানে এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের সঠিক হিসাব প্রদান করা হলে এবং নির্বাচন কমিশন তা যাচাই-বাছাই করলে, প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়তা নিয়ে যাঁরা অযাচিতভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে, যার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করা যাবে। বস্তুত এর মাধ্যমে হলফনামা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য আমলনামায় পরিণত হতে পারে। এ জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে হলফনামার ছকে কিছু পরিবর্তন। এ লক্ষ্যে হলফনামার একটি নতুন ছক তৈরি করে কমিশনকে দেওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের থেকে কোনো সাড়া পাইনি।
বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)