আর কয়েক দিন পরই শুরু হবে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে বইমেলা’। মাসজুড়ে অসংখ্য পাঠক সেখানে যাবেন, বই দেখবেন ও কিনবেন।
মা-বাবার সঙ্গে অনেক শিশুও আগ্রহ নিয়ে বইমেলায় যায়। নিজের পছন্দমতো বই সংগ্রহ করা তাদের বই পড়ার ব্যাপারে আরও আগ্রহী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বই পড়লে শিশুরা আনন্দ পায়, তাদের কল্পনাশক্তি বাড়ে। বই পাঠ শিশুদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা, মনোযোগ ও যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
শিশুরা যাতে নিরাপদে, স্বাচ্ছন্দ্যে ও আনন্দের সঙ্গে বইমেলায় সময় কাটাতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিশু চত্বরে এমন প্রকাশকেরা স্টল দেন, যাঁরা শিশুদের জন্যই বই প্রকাশ করেন। এ ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনী থেকে শিশুদের বই বের হয়, তাদের স্টলগুলো থাকে মেলাজুড়েই। এ জন্য পুরো মেলার আয়োজনেই শিশুদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
শিশু চত্বরে প্রবেশের সময় একটা আকর্ষণীয় দরজা রাখা দরকার, এর মাধ্যমে শিশুদের একটা আলাদা জগতে প্রবেশের অনুভূতি হবে। শিশুদের বয়সের কথা বিবেচনা করে রং, ছবি, ফন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে শিশু চত্বরকে সাজালে, তা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। শিশুদের উচ্চতা উপযোগী পানি পানের জায়গা, শৌচাগার ও বেসিনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অল্প বয়সী শিশুদের নিয়ে যে মায়েরা আসেন, তাঁদের জন্য মাতৃদুগ্ধ পানের কর্নার রাখতে হবে।
শিশু চত্বরের ভেতরে বা তার কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা করা উচিত, যেখানে শিশুরা তাদের প্রিয় লেখকদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে। মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন শিশুতোষ বই কিংবা পঠিত অন্যান্য বই সম্পর্কে যাতে শিশুরা তাদের মতামত ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, সে জন্য আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এর ফলে শিশুরা কী ধরনের বই পড়তে আগ্রহী, সে সম্পর্কে লেখক ও প্রকাশকেরাও ধারণা পাবেন। শিশু প্রাঙ্গণে এমন এক বা একাধিক জায়গা নির্ধারিত থাকা দরকার, যেখানে শিশুরা গল্প পাঠ, গল্প লেখা, অলংকরণ, গল্পের প্রিয় চরিত্রের মতো সাজা ইত্যাদির মাধ্যমে সৃজনশীল সময় কাটাতে পারবে।
শিশুপ্রহর ঘিরে শিশুদের আগ্রহ থাকে; অনেক শিশু তখন মা-বাবার সঙ্গে মেলায় আসে। কিন্তু সেই সময় অন্যরাও মেলায় যেতে পারে। এতে শিশুপ্রহরের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। শিশুপ্রহরের কয়েক ঘণ্টা শিশু এবং তাদের সঙ্গে আসা অভিভাবকদের জন্যই বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। শিশু সঙ্গে না থাকলে বয়স্ক কারও সেই সময়ে মেলায় ঢোকার অনুমতি না থাকলেই ভালো।
প্রকাশকদের শিশুতোষ বই প্রকাশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বইয়ের বিষয়, ভাষা, অলংকরণ, কাগজ ও ছাপার মান উন্নত করে শিশুদের উপযোগী বই প্রকাশ এখন সময়ের দাবি। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, চিরায়ত সাহিত্য, রূপকথা, পুরাণসহ নানা বিষয়ে বই প্রকাশ করা দরকার। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুতোষ বইয়ের কাহিনি, অলংকরণ এবং মুদ্রণ নিয়ে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আমরা তা করছি কি? শিশুদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে পাঠকের বয়স অনুযায়ী কাগজের ধরন, বাঁধাই, কাটিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও সম্ভাবনাকে আমরা কি কাজে লাগাচ্ছি? বইয়ের বিষয় এবং ছাপার মান ভালো না হলে তা শিশুরা পড়তে চাইবে না, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
বইমেলায় স্টলে বই প্রদর্শনের জায়গাগুলো শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী তৈরি করা ইচ্ছা থাকলেই সম্ভব। শিশুরা যখন কোনো স্টলে যাবে, তখন বিক্রয়কর্মীরা তাদের গুরুত্ব দিয়ে সংবেদনশীল আচরণ করবেন। শুধু বড়রাই নন, শিশুরাও ক্রেতা—বিষয়টি মনে রাখা জরুরি। যেসব প্রকাশক বড়দের পাশাপাশি শিশুতোষ বইও প্রকাশ করেন, তাঁরা স্টলের একটি অংশ শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় নকশায় তৈরি করতে পারেন। এই বিষয়ে যাঁরা স্টলগুলোর নকশা করেন, তাঁদের সচেতনতা ও দক্ষতার প্রয়োজন।
কোনো কোনো অভিভাবকের অভিযোগ, মানসম্মত বই না থাকার কারণে শিশুরা ইংরেজি বই পড়লেও বাংলা বই পড়তে চায় না। বর্তমানে শিশুরা খুব দৃশ্যনির্ভর একটা জগতে বসবাস করে, অ্যানিমেশন বা অন্যান্য চলচ্চিত্র, ভিডিও ও কম্পিউটার গেমসে প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব আকর্ষণীয়ভাবে গল্প উপস্থাপন করা হয়। এগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই বইকে টিকে থাকতে হবে। বইয়ের মান উন্নত করার বিকল্প নেই।
বিভিন্ন বয়সের শিশুদের অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও পড়ার গতি আলাদা। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এসব বিবেচনা করেই বই লিখতে হবে।
বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় পরিবারে। তিন থেকে ছয় মাস বয়সেই শিশুদের বই দেওয়া উচিত। সেই বইগুলো এমন হতে পারে, যাতে কোনো লেখা নেই, শুধু ছবি আছে। যখন শিশু কথা বলতে ও বুঝতে শেখে, তখন থেকেই যদি মা-বাবা এবং অভিভাবকেরা বই পড়ে শোনান, তাহলে তারা বই ভালোবাসতে শিখবে। যখন শিশু পড়তে শুরু করে, তখনই তার নিজের পড়ার জন্য বই দিতে হবে।
বই কেনার জন্য পারিবারিক বাজেটে বরাদ্দ রাখা এবং সন্তানদের পছন্দমতো বই কেনার স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন। পাঠাগার, বইমেলায় এবং বইয়ের দোকানে নিয়ে যাওয়া, শিশু বই পড়ে গল্প বা প্রশ্ন করলে আগ্রহ নিয়ে শোনা এবং আলোচনা করা, বিভিন্ন উৎসব ও জন্মদিনে উপহার হিসেবে বই দেওয়া শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গঠনে ভূমিকা রাখে। মা-বাবাকে বই পড়তে দেখলে শিশুরা জানবে যে বই পড়া প্রতিদিনের জীবনের একটা অংশ।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী