লম্বা বিরতির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দেশে আবারও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই দফায় আমরা নতুন দুটি জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম জানতে পারছি। এর মধ্যে আলোচনায় থাকা গোষ্ঠীটির নাম জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। বলা হচ্ছে, আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি, হুজি-বি, আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যদের একত্র করার একটা চেষ্টা আছে তাদের।
পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ, অবস্থান, অস্ত্র সরবরাহ ও আশ্রয় দিচ্ছে। সংগঠনটিতে যোগ দিতে অন্তত ৫৫ জন এখন পর্যন্ত ঘর ছেড়েছেন। আর কেএনএফের হামলায় নিহত হয়েছেন দুজন সেনাসদস্য।
তরুণেরা তথাকথিত হিজরত করে গোপন ডেরায় গিয়ে উঠছেন, কেএনএফ এর হাতে সেনাসদস্যরা প্রাণ হারিয়েছেন —এসব খবরে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠনের হামলায় দেশি-বিদেশি ২২ জন নৃশংসভাবে খুন হওয়ার স্মৃতি মানুষের মনে স্পষ্ট। আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের তৎপরতাও তখন তুঙ্গে। বেছে বেছে লেখক-প্রকাশক-মুক্তমনা-সংস্কৃতিকর্মী-সমকামীদের কুপিয়ে হত্যার ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), র্যাব ও দু-একটি অভিযানে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এসব অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিহত ও আহত হয়েছেন। জঙ্গি আস্তানায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী জঙ্গি ছাড়াও নিহত হয়েছে শিশু, গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের অপেক্ষায় আছেন বহু মানুষ। এর মধ্যেই পত্রপত্রিকায় আবারও পুলিশ-র্যাবের অভিযানে জঙ্গি গ্রেপ্তারের খবর বেরিয়েছে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা শামিন মাহফুজ। শামিন ইসলামী ছাত্রশিবিরে জড়িয়ে পড়ায় রংপুর ক্যাডেট কলেজ তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া শামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তিনি জমিয়াতুল মুসলেমিন নামে একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুর্ধর্ষ জঙ্গি এজাজ কারগিলের সহযোগী ছিলেন। এজাজের স্ত্রীকে পরে তিনি বিয়েও করেছেন। পিএইচডি করার আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মান্তর করা ও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করছেন। তাঁর কাছ থেকে অপারেশন ম্যানুয়াল উদ্ধার হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গী গোষ্ঠীটির বিস্তার।
পুলিশ আরও বলছে, এসব কাজে শামিন সহযোগিতা নিচ্ছেন নাথান বমের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাথান ছিলেন শামিনের প্রিয় বন্ধু। পাশাপাশি হলের ছাত্র হওয়ায় দুজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার কাজে তাঁরা দুজনে জোট বেঁধেছেন। সিটিটিসি ও র্যাব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
সবশেষ মাসখানেক আগে মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে নারী-শিশুসহ ১০ জন। তাঁরা আবার ইমাম মাহমুদের ‘কাফেলা’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য।
অন্যদিকে র্যাব জানায়, পাহাড়ি এলাকার ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে কেএনএফ গড়ে উঠেছে। এর প্রধান নাথান বম। গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু করে র্যাব পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ মোট ৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই সব অভিযানে কেএনএফের ১৭ নেতা ও সদস্যও গ্রেপ্তার হন। তাঁদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও উগ্রবাদী বই উদ্ধার করা হয়।
কথা হলো, শামিন মাহফুজ এর আগেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শামিন তিনবার নিখোঁজ হন। এ নিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রথম আলোয় ‘শামিন মাহফুজ কোথায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল।
পরিবারের সদস্যরা সে সময় জানিয়েছিলেন, ২০১১ সালের ২৭ মার্চ গবেষণা ও কৃষি খামারের আড়ালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার অভিযোগে শামিনের বিরুদ্ধে বান্দরবানের থানচি থানায় প্রথম একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।
পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুল উপস্থিতির পরও কী করে কেএনএফ সংগঠিত হলো? তারা কাদের চোখ এড়িয়ে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল? এ এক বিরাট বিস্ময়। তারা একে-৪৭–সহ নানা জাতের ভারী অস্ত্রশস্ত্রই-বা কোথা থেকে জোগাড় করছে? কারা টাকা দিচ্ছে অস্ত্র কেনার? বিক্রি করছে কারা? আমরা তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নাথান বমের হাসিমুখ ছবি দেখতে পাই।
২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল বান্দরবান আদালতে হাজিরা দিয়ে চকরিয়ায় ফেরার পথে তিনি নিখোঁজ হন। ২০১৪ সালের ২ জুলাই তিনটি ককটেলসহ পুলিশ শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার দেখায়। ওই মামলায় তিনি ২০১৭ সালের ১৬ জুন পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। জামিনে মুক্তির পরপরই তিনি কারাফটক থেকে নিখোঁজ হন। কিছুদিন পর তিনি ফিরে আসেন। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট বান্দরবান আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বিচারক তাঁকে বান্দরবান কারাগারে পাঠান। ওই বছর ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন।
পুরো বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে, যার জবাব এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। যেমন দফায় দফায় শামিন মাহফুজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের হেফাজতেও কারাগারে ছিলেন। আবার সেখান থেকে পার্বত্য অঞ্চলে ফিরে গেছেন। এরপরও কীভাবে তিনি এমন একটি জঙ্গি গোষ্ঠী গড়ে তুললেন?
তা ছাড়া ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকেই আমরা ডির্যাডিকালাইজেশন (জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি) কর্মসূচির কথা শুনে আসছি। যিনি কোনো না কোনোভাবে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন তিনি কেন এ ধরনের কর্মসূচির বাইরে থেকে গেলেন? জঙ্গি ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এলে শামিন সম্পদ হতে পারতেন; কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তরুণেরা বাড়ি ছেড়ে জঙ্গিদের ডেরায় গিয়ে উঠেছেন।
প্রশ্ন ওঠে নাথান বমকে নিয়েও। পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুল উপস্থিতির পরও কী করে কেএনএফ সংগঠিত হলো? তারা কাদের চোখ এড়িয়ে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল? এ এক বিরাট বিস্ময়। তারা একে-৪৭–সহ নানা জাতের ভারী অস্ত্রশস্ত্রই-বা কোথা থেকে জোগাড় করছে? কারা টাকা দিচ্ছে অস্ত্র কেনার? বিক্রি করছে কারা? আমরা তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নাথান বমের হাসিমুখ ছবি দেখতে পাই।
আবার এ বছরের ২৩ জুলাই বিবিসি বাংলার খবরে আমরা জানতে পারি, কেএনএফের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারপর কী হলো? সে খবর আমরা আর পাইনি।
নির্বাচনের আগে সত্যিই কি আমরা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছি? সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথা শুনে বুক কেঁপে ওঠার কথা। গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর পলাশী চৌরাস্তায় কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমী উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সময়টা খারাপ। এবার আমি ভয় পাচ্ছি যে অশুভ শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটায়, যেটা হিন্দুদের সাথে এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের ফাটল ধরাতে পারে। রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী, দুর্বৃত্তরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। কাজেই এবার বেশি করে সতর্ক থাকতে হবে।’
তবে সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কার্যক্রম এখনো খুব বেশি ছড়ায়নি। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি আছে, তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ওয়ার্ল্ড টেররিজম ইনডেক্সও বলছে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ঝুঁকি মোকাবিলায় ভালো করছে। এখন বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম। ২০২২ সালে মাত্র দুটি ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন দুজন।
বিশেষজ্ঞরা তো বলেই থাকেন, বাংলাদেশের মাটি জঙ্গিবাদের জন্য উপযুক্ত নয়। যখনই জঙ্গিবাদ ডালপালা মেলেছে, তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তা ছেঁটে দিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডগলাস কেলার ‘বুশস্পিক অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব লাইং: প্রেসিডেনশিয়াল রেটোরিক ইন দ্য ওয়ার অন টেরর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, উপসাগরীয় যুদ্ধের পর এইচ ডব্লিউ বুশের যে দশা হয়েছিল, ঠিক সেই দশায় পড়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতলেও অর্থনীতির অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। এই অবস্থায় পুনর্নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা ছিল কঠিন। বুশ-চেনি চাইলেন এমন কিছু ঘটাতে, যা তাদের জিতে আসা ঠেকাতে পারবে না। টার্গেট হলেন সাদ্দাম, কথিত ‘উইপনস অব ম্যাস ডেস্ট্রাকশন’ রাখার কারণে। আর মাইকেল মুর বোলিং ফর কলম্বাইন প্রামাণ্যচিত্রে দেখিয়েছিলেন, মানুষের মনে ভয় চিরজাগরূক করে রাখতে বুশের এই কৌশলে বাতাস দিয়েছিল বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম।
বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদকে নিয়ে নানা রাজনৈতিক দল নানাভাবে খেলার চেষ্টা করেছে, এর ফল কখনো ভালো হয়নি। ভালো হয়না।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com