মতামত

আশ পুরিয়ে সমাবেশ করল বিএনপি, তবু মনে সংশয়

গত প্রায় এক যুগ সভা-সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ার যে খেদ ছিল বিএনপির, বলতে গেলে সেই শোক-দুঃখ তারুণ্যের সমাবেশ করে উশুল করে নিয়েছেন তারা
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের ডাকে তারুণ্যের সমাবেশ উপলক্ষে শাহবাগের মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পথে যান চলাচল ছিল বন্ধ। আর অন্য সড়কগুলোয় তীব্র যানজট। এর মধ্যেই দুপুরের চড়া রোদ উপেক্ষা করে মাথায় ফেট্টি, ক্যাপ পরে রাস্তার দু’ধারে বিএনপির নেতা-কর্মী সমর্থকেরা উদ্যানের দিকে ছুটছিলেন। কারও হাতে ধানের শিষের ছড়া, কারও হাতে বিএনপির দলীয় পতাকা, কারও হাতে ব্যানার।

ঢাকার এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যুগপৎ প্রস্তুতি ছিল। আওয়ামী লীগ টুইটারে তাদের প্রচারণা চালিয়েছে, দ্য জার্নি অফ ডেমোক্রেসি নামে। কীভাবে মৌলবাদী ও স্বৈরশাসকের প্রতিবন্ধকতা জয় করে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে তার সচিত্র কার্ড প্রচার করেছে তারা। আর বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশের স্লোগান ছিল ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ।’

দুই দলই বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে ছাপা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একটির পর একটি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী ছিল তা নিয়ে বিএনপি পত্রিকার প্রতিবেদন নতুন করে সামনে এনেছে। আর আওয়ামী লীগ এনেছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মাগুরার উপনির্বাচন আর ২০১৩র জ্বালাও পোড়াও এর ছবি।

 গত প্রায় এক যুগ সভা-সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ার যে খেদ ছিল বিএনপির, বলতে গেলে সেই শোক-দুঃখ তারুণ্যের সমাবেশ করে উশুল করে নিয়েছেন তারা। টেনিস কোর্টের উল্টোদিকে পুলিশের উপস্থিতিতে একের পর এক মিছিল নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশ স্থলে ঢুকেছেন। উদ্যানের ভেতরের পিলারে শোভা পেয়েছে তারেক জিয়া এবং লুৎফুজ্জামান বাবরের ছবি। গিয়াসউদ্দীন আল মামুনের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েও পোস্টার ঝুলতে দেখা গেছে। সমাবেশ স্থলের কাছে অনেককেই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতে, ফেসবুক লাইভে থাকতে দেখা গেছে।

দেদারে বিক্রি হয়েছে কুলফি, আইসক্রিম, পেয়ারা, আমড়া, ঝালমুড়ি আর হটপেটিস। গান ও কবিতার উপস্থাপনও ছিল। ফুল ভলিউমে বেজেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার স্তুতিমূলক গান। একটি গানের লাইন ছিল এমন, ‘ তুমি শক্তি, তুমি বল, তুমি আলোর দিশারী, তুমি স্বপ্ন, তুমি আশা, তুমি লাল-সবুজের/তুমি খালেদা জিয়া/ কোমল তোমার হিয়া।’

ঢাকার লালবাগ এলাকার বিএনপি কর্মী মো রাসেল ঢালী দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগই তাঁকে বিএনপি বানিয়েছে

বিএনপি নেতা-কর্মীরা সরকার পতনের দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন ঐক্যবদ্ধভাবে। তবে বিভিন্ন বয়সী তিনজন নেতা কর্মী এই সমাবেশে অংশগ্রহণের পক্ষে প্রথম আলোর কাছে তিন ধরনের যুক্তি দেখিয়েছেন। ঢাকার লালবাগ এলাকার বিএনপি কর্মী মো রাসেল ঢালী দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগই তাঁকে বিএনপি বানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি  ইমরান হোসেন শাকিল বলেছেন, দলের প্রয়োজনে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। আর ৭৪ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ভাতাভোগী বিএনপি নেতা গোলাম রব্বানী চান মৃত্যুর আগে সরকার বদল হোক।

লালবাগের রাসেল ঢালীর মুঠোফোন সারাইয়ের দোকান আছে। কীভাবে আওয়ামী লীগ তাঁকে বিএনপি বানিয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, একটা সময় ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা লুট করত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অস্ত্রবাজি নেই, কিন্তু চাঁদা দিতে হচ্ছে। না দিলে টিকে থাকা মুশকিল।

২০০৮-১৩ পর্যন্ত তাঁর ভাষায় সরকার দেশ ভালো চালিয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। এরপর দলটির স্বভাব বদলে যায়। এমনকি ২০১৮ সালে তিনি গণগ্রেপ্তারের শিকার হন। তিনিসহ লালবাগের ২৭ জনকে সরকারি কাজে বাধা, ভাঙচুর ও বিস্ফোরক আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৭৪ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি নেতা গোলাম রব্বানী

এ সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তাঁর কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এসব কিছু নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত। ভোটারদের কোনো দাম নেই এই ভাবনাও তাঁকে পীড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘তাওয়ায় রুটি দিলে উল্টাইতে হয়, নইলে জ্বইলা যায়। এখন মার্কা পাইলেই ভোটে পাশ। তাই ভোটারদের দাম নাই।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ইমরান হোসেন শাকিল দুই সপ্তাহ আগে তেরোদিন জেল খেটে বেরিয়েছেন। তারপরও দলীয় সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর মতে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এই মুহূর্তে তাঁদের লক্ষ্য যারা ভোট দিতে পারেননি সেসব তরুণদের তাঁদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা। এতে করে তাঁদের দাবি আদায় সহজ হবে।

কাফরুল থানা বিএনপির নেতা সত্তোরোর্ধ্ব গোলাম রব্বানী নিজেকে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মচারী বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি বিএনপির সমর্থক। দল করার কারণে প্রতিরাতে তাঁর বাসায় গোয়েন্দা সংস্থার লোক আসে। তাঁর ছেলে-মেয়েদের চাকরি হচ্ছে না, তারা ব্যবসা করতে পারছে না। বিএনপি ছাড়া আর কেউ দেশ চালাতে পারবে না।

সে কারণে তিনি চান তাঁর দল ক্ষমতায় আসুক। তাঁর মতে জোর-জুলুমের কারণে ‘জমিন ফাঁক’ হয়ে গেছে । চাল-ডাল-আটা- মসলা সবকিছুর দাম বেশি, পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেশি। এবার আর পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ লোকজনের আচরণ বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চোরের মতো। তাঁর সব বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

নির্বাচনে কী হবে? নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানতে তাঁরা আওয়ামী লীগকে বাধ্য করাবেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় তাঁদের দলের প্রস্তুতি ভালো। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বুদ্ধিতে তাঁদের চেয়ে এগিয়ে কি না এমন প্রশ্নে বলেছেন, সবাই নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে। বুদ্ধির জোরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকেছিল অনেক দিন। তবে তারা প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়েছে। সহযোগিতা না পেলে তাঁরাও দেখিয়ে দিতেন।

ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ ছিল। তৎকালীন বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে, জজমিয়া নাটকও মানুষের মনে আছে। তা ছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে বিএনপির কর্মসূচির মধ্যে জ্বালাও পোড়াও এর ঘটনা ঘটেছে অজস্র। বহু মানুষ মারা গেছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন। এসব নিয়ে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের বক্তব্যে মিল-অমিল দুই-ই পাওয়া যায়।

লালবাগের রাসেল মনে করেন, সহিংসতার কোনো জায়গা রাজনীতিতে থাকার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘২০১৩-১৪ সালে জ্বালাও পোড়াও আওয়ামী লীগ খোদ করাইছে। আমি চাই এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। আমরা তো দেশের বাইরের কেউ না। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বিএনপির কেউ দোষী হলে বিচার হোক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দিসে। আওয়ামী লীগেরগুলোসহ বিচার করেন। আমি এই সবের বিরুদ্ধে না। ন্যায্য বিচার হোক।’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসা বিএনপির কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিল না

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইমরান বিশ্বাসই করেন না বিএনপি সহিংসতা করেছে। তাঁর দাবি বেশির ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগের এক নেতা নিজেই নিজের আসে আগুন দিয়েছে, এই নিয়ে তাঁদের দলের লোকই কথা বলেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁরা গুম, গণগ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন।  

নির্বাচনে কী হবে? নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানতে তাঁরা আওয়ামী লীগকে বাধ্য করাবেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় তাঁদের দলের প্রস্তুতি ভালো। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বুদ্ধিতে তাঁদের চেয়ে এগিয়ে কি না এমন প্রশ্নে বলেছেন, সবাই নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে। বুদ্ধির জোরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকেছিল অনেক দিন। তবে তারা প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়েছে। সহযোগিতা না পেলে তাঁরাও দেখিয়ে দিতেন।

তবে, এতকাল পরে আওয়ামী লীগ সরকার কেন সমাবেশ করতে দিচ্ছে তা নিয়ে সংশয়ও আছে। সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন তাঁরা।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    ইমেইল: sabiha.alam@prothomalo.com