মতামত

সোনায় মোড়া সব জিলাপি সাবাড়

সম্প্রতি রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিক্রি হয় সোনার প্রলেপ দেওয়া বিশেষ ধরনের এ জিলাপি
ছবি:  হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর সৌজন্যে

পবিত্র রমজান মাসের প্রায় মাঝামাঝি প্রথম আলোয় একটা খবর পড়ে বিস্ময়ে আঁতকে উঠেছিলাম। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল খাওয়ার উপযোগী সোনায় মোড়া জিলাপি বিক্রি করছে। এক কেজি জিলাপির দাম মাত্র ২০ হাজার টাকা। ছিটেফোঁটা কিনতে হলে সবচেয়ে কম নিতে হবে ২৫০ গ্রাম, যার মূল্য ৫ হাজার টাকা।

১০ এপ্রিল বিকেলে প্রথম আলোর সর্বশেষ অনলাইন সংস্করণের খবরটি পড়লাম। খবরটা হলো সোনায় মোড়া সব জিলাপি সাবাড় হয়ে গেছে। হোটেলটি যত জিলাপির ব্যবস্থা করেছিল, তা ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে, আর সাপ্লাই নেই।

প্রথম আলোয় আজকাল ভুলভাল চোখে পড়ছে। জিলাপি শেষ হয়ে যাওয়ার খবরটা ১০ এপ্রিল, অর্থাৎ সোমবারের। কিন্তু অনলাইন সংস্করণে লেখা আছে, ‘আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে’ প্রথম আলোর সংবাদদাতা জানতে পেরেছেন যে সোনায় মোড়া জিলাপির জন্য আর কোনো অর্ডার নেওয়া হচ্ছে না।

পরে দেখি সোমবার সোমবারই আছে। সোমবার–বুধবারের ত্রুটি আর দেখা যাচ্ছে না। না থাক, কিন্তু এ ভুল ক্ষমা করব কি না, সেটা এখনো ঠিক করিনি। ভাবছি, একহাত দেখে নেব। শুধু চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হব না। সোনায় মোড়ানো জিলাপির ব্যাপার, অতএব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে অন্তত গোটা বিশেক।

২.

লোকমুখে শুনেছি, দুবাই-আবুধাবির মতো রাজা-বাদশাহদের দেশে খাওয়ার উপযোগী সোনা পাওয়া যায়। হাজার হলেও রাজা-বাদশাহদের দেশ। ওই সব দেশেই পাওয়া যাবে এসব জিনিস। তবে আমরা তো এখন আর পিছিয়ে নেই। উন্নয়নশীল দেশ হয়েই গেছি, আর দেড় দশকের একটু পরেই উন্নত দেশ বনে যাওয়ার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি শুনছি অহরহ।

উন্নত দেশের একটু আগাম স্বাদ দেওয়ার জন্যই হয়তো সোনার জিলাপির ব্যবস্থা। হয়তো জিলাপি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিছক টু পাইস কামাই করা। কামাইটা যে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে, তা হয়তো তারা আশা করেনি। তবে আগামী রমজান মাসে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি নিশ্চয়ই হবে না। এক বছরে আমাদের উন্নতি হবে আরও অনেক, জিলাপিখাদকের সংখ্যাও বাড়বে অনেক।

অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যঁারা যথেষ্ট চালাক নন, তঁারা মনে করেন, এ দেশে নাকি চার থেকে পাঁচ কোটি লোক তিনবেলা পেটপুরে খাবার খেতে পারেন না। তাঁরা দেশের উন্নতির সঠিক খবর রাখেন না। সন্দেহ হয়, প্রথম আলোর মতো শত্রুভাবাপন্ন দুই পয়সার পত্রিকা দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত।

তবে দেশে সঠিক ভাবধারার বিজ্ঞজনের অভাব নেই। এ ব্যাপারে মাঝেমধ্যে কোনো যে সন্দেহ হয়নি, তা হলফ করে বলতে পারব না। তবে ইদানীং আশ্বস্ত হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিবৃতি/দাবির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হয়ে। এক বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, দেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় মহান স্বাধীনতা দিবসে সংবাদ প্রকাশের নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে।

গণতন্ত্রের অল্প কিছু যে অবশিষ্ট আছে, সেটাও হয়তো থাকবে না, যদি সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ক্রমাগত বজায় থাকে। সরকারি দলের সব স্তরের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, কিছু কিছু বিশিষ্টজন এবং সাংবাদিকদের একাংশও যদি বাক্‌স্বাধীনতা হরণের আত্মঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হন, তবে আগামী বছরগুলোয় সোনার জিলাপির বিক্রি বাড়বে অনেক গুণ, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সম্ভবত হাজার গুণ বাড়বে ভুখা মানুষের দল। তবে ভুখা মানুষ আর খবরে আসবে না। আমরাও জানব না, কথাও বলব না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ ধরনের অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।’ (ঢাকা ট্রিবিউন অনলাইন, ৩১ মার্চ, রাত ৯.৪৫)। এককালে অধমও এই শিক্ষক সমিতির সদস্য ছিল, তাই সঠিক কাজের জন্য গর্বটা অনেক বেশি। তবে যেহেতু আইন নিয়ে ঘ্যাটরম্যাটর করি, তাই বলেই ফেলি, শুধু ষড়যন্ত্র নামক কোনো অপরাধ আইনে নেই। যদিও আজকাল চারদিক থেকে তারস্বরে চিৎকার শুনি—ষড়যন্ত্র হচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

ধরুন, আমরা চারজন মিলে প্ল্যান করতে বসলাম, কীভাবে একটা ব্যাংকে ডাকাতি করব। দায়িত্ব বণ্টন হলো। একজন রশি জোগাড় করবে, আরেকজন বালতি, তৃতীয়জন ঠেলাগাড়ি, চতুর্থজন গাদাবন্দুক। কিন্তু শেষতক আমরা কোনো ব্যাংকের ধারেপাশেই গেলাম না, ডাকাতি তো দূরেই থাক। চারজনে এককাট্টা হয়ে বসে যে প্ল্যানিং হয়েছিল, সেটাকে কেউ ষড়যন্ত্র বললেও বলতে পারেন। কিন্তু ডাকাতি না করার কারণে সেই প্ল্যানিং আইনের চোখে অপরাধ বলে গণ্য হবে না। একটা ষড়যন্ত্র তখনই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, যখন সেই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হয়।

সমমনা বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বার সমিতিও। এককালে ওই সমিতিরও সদস্য ছিলাম। আর বর্তমানে যে সমিতির সদস্য আছি, সেই সমিতিও অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনও বিবৃতির মাধ্যমে প্রথম আলোর মুণ্ডুপাত করেছে এবং প্রথম আলোর গভীর ষড়যন্ত্রের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে।

ভাবছি, কোন সমিতির সঙ্গে একই সুরে গান গাই। তবে সুর মেলানোর একটা সমস্যা আছে। হালুয়া-রুটির বয়স পেরিয়ে গেছে। এই বয়সে হালুয়া-রুটি প্রত্যাশা করা আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখার শামিল। হালুয়া-রুটি যখন পাবই না, তখন সুর মিলেয়ে কী লাভ!

৩.

আমেরিকার প্রায় সবকিছুই খারাপ। শুধু যে জানি তা-ই নয়, হাড়ে হাড়ে টেরও পেয়েছি বিস্তর। গত শতাব্দীর আশির দশকের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছি মার্কিন মুলুকে। এরপরও গিয়েছি; অবশ্য ইদানীং আর যাওয়া হয় না। তবে প্রতিনিয়ত ‘ম্যাস-শুটিং’-এর খবর রাখি; শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের খুন হওয়ার খবরও রাখি।

আরও খবর রাখি ও মনে পড়ে ২০ বছর আগের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাগদাদ শহরের মাঝখানে স্থাপিত অতি উচ্চকায় সাদ্দাম হোসেনের মূর্তিটি টেনে ফেলে চুরমার করার দৃশ্য। সেই ২০ বছর আগে ইরাককে সাদ্দাম হোসেনমুক্ত করার যুদ্ধ এবং তার পরবর্তীকালে মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিলেন সাড়ে চার হাজারের মতো। আর সাদ্দাম হোসেনমুক্ত ইরাকে গত ২০ বছরে প্রাণ গেছে পাঁচ লাখের অধিক ইরাকির।

ভালো-খারাপ মিলিয়ে প্রতিটি দেশ। অনেক খারাপের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটা বিধান আমার অতি প্রিয়। এ বিধান সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল ১৭৯১ সালে। এটি এতই প্রিয় যে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছি বেশ কয়েকবার। প্রথম আলোতেও হয়তো লিখেছি। পুনরাবৃত্তি হলে আগে থেকেই দুঃখ প্রকাশ করছি, যদি পাঠকের বিরক্তির কারণ হই।

মার্কিন কংগ্রেস অর্থাৎ ওই দেশের সংসদ বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব বা সংকুচিত করে—এমন বিধানসংবলিত কোনো আইন পাস করতে পারবে না। ১৭৯১ সাল থেকে সে দেশে আপনি যা ইচ্ছা তা–ই বলতে পারবেন। কটাক্ষ, ভাবমূর্তিতে আঘাত, মনে কষ্ট দেওয়া, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী যেন করা ইত্যাদি ইত্যাদি—সবকিছুই বলতে পারবেন। এসব কথা বলার জন্য ওই দেশের পুলিশের সাধ্য নেই আপনাকে গ্রেপ্তার করার।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংসদের অর্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে ৭ এপ্রিল তাঁর ভাষণে অনেক কথার মধ্যে এটাও বলেছিলেন, গণতন্ত্রের অভাব থাকলে উন্নয়ন সর্বব্যাপী হয় না।

সবার যদি কমবেশি উন্নতি হতো, তাহলে এ দেশে সোনার জিলাপি খাওয়ার লোক থাকার কথা ছিল না। কোটি কোটি মানুষের উন্নতি হয়নি। আর তাই কিছু মানুষের উন্নতি এত বেশি হয়েছে যে এক সপ্তাহের মধ্যেই সব সোনার জিলাপি শেষ হয়ে গেছে।

গণতন্ত্রের অল্প কিছু যে অবশিষ্ট আছে, সেটাও হয়তো থাকবে না, যদি সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ক্রমাগত বজায় থাকে। সরকারি দলের সব স্তরের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, কিছু কিছু বিশিষ্টজন এবং সাংবাদিকদের একাংশও যদি বাক্‌স্বাধীনতা হরণের আত্মঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হন, তবে আগামী বছরগুলোয় সোনার জিলাপির বিক্রি বাড়বে অনেক গুণ, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সম্ভবত হাজার গুণ বাড়বে ভুখা মানুষের দল। তবে ভুখা মানুষ আর খবরে আসবে না। আমরাও জানব না, কথাও বলব না।

  • ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক