উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে বিএনপি কী করবে

আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনে ১৯৭০ সালের পর থেকে মানুষের মধ্যে নানা উত্তেজনা ও রেষারেষি চলে আসছে। সব সময়ই জাতীয় নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয়ে আসছে। সত্তর ও আশির দশকের নানা টালমাটাল অবস্থার পর ১৯৯১ সালে এসে জাতীয় নির্বাচনে একটা থিতু অবস্থা তৈরি হয়। ফের এক-এগারোর পর পরিপ্রেক্ষিত অনেকটাই পাল্টে যায়।

২০০৮–এর নির্বাচন থেকে কার্যত একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হয়; অর্থাৎ বিরোধী দল থাকলেও তারা সংসদে নেই বা কার্যকর নয়। আর ২০১৪ সাল থেকে যাদের বিরোধী দলে পাচ্ছি, তাদের এককথায় ‘গৃহপালিত’ বলা যায়। আমাদের দেশে এ ধরনের বিরোধী দল আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে।

জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন জনগণের সরাসরি ভোটে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ শত বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান। এটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ সব সময়ই বেশি। কেননা, এই নির্বাচন স্থানীয়ভাবে হয়। প্রার্থী যাঁরা, তাঁদের গ্রামের মানুষ চেনেন। একটা সময় পর্যন্ত দেখা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরা সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে সচ্ছল কিংবা শিক্ষিত, যাঁদের সামাজিক মর্যাদা বেশি—এ রকম মানুষেরাই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান হতেন।

কিন্তু সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। ১৯৭১-এর পর স্থানীয় সরকারের ক্ষমতাকাঠামো একটা নতুন প্রজন্মের কাছে চলে গেছে। যাঁদের টাকা বেশি এবং যাঁদের পেশিশক্তি আছে, তাঁরা শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচনও নিয়ন্ত্রণ করছেন। ভালো মানুষেরা দূরে সরে গেছেন, আর নতুন টাকাওয়ালারা টাকা ও পেশিশক্তির জোরে সব দখল করে নিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার চেয়ারম্যান-মেম্বার যাঁরা হতেন, তাঁরা খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের কাছে মর্যাদার বিষয়টাই ছিল বড়। আমরা এ রকম শুনেছি এবং ছোটবেলায় কিছু কিছু দেখেছিও, অনেক জমিজমা আছে, এমন ব্যক্তিরা তাঁদের জমিজমা বিক্রি করে জনকল্যাণের কাজ করেছেন, নির্বাচনও করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানরা সে সময় কোনো বেতন-ভাতা পেতেন না। এখন স্থানীয় সরকারে যাঁরা যান, তাঁরা বেতন-ভাতা পান। আরও নানা রকমের আয়ের পথ তাঁদের খুলে গেছে।

বাংলাদেশে যতগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আছে, তাদের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে প্রচুর সম্পদ যায়, বাজেট যায়। সেখানে নানা রকমের নয়ছয়ের সুযোগ তৈরি হয়। এভাবে অনেকে ফুলেফেঁপে উঠছেন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের জায়গা দুটি। প্রথমত, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিজ নিজ গ্রামের উন্নয়নকাজ করা যায়। মানুষ ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানকে সরাসরি এসব নিয়ে কথা বলতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ইউনিয়ন পরিষদের চরিত্র অনেক দিন পর্যন্ত অরাজনৈতিক ছিল। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে কিংবা পরিচিতির মাধ্যমে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতো।

২০১৫ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার আইন পরিবর্তন করে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে অবশ্য দলের লোকেরাই নির্বাচন করতেন, কিন্তু প্রতীকটা থাকত আলাদা। দলের প্রতিনিধি হিসেবে কেউ নির্বাচন না করায় দলমত-নির্বিশেষে ভোটারদের যাঁকে যাঁর ভালো লাগত, তাঁরা তাঁকেই ভোট দিতেন। সরকারের সে সময় খেয়াল চাপল, কেন্দ্রে তো তারা আছে, স্থানীয় সরকারগুলোরও নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে।

দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হোক না কেন, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব থাকে এবং নির্বাচনটা তারা তাদের পক্ষে নিয়ে যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেটাই হয়েছে।

বেশির ভাগ জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা স্থানীয় সরকার দখল করে বসে আছেন। তাতে কিন্তু স্থানীয় জনগণের কোনো লাভ হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতি হয়েছে। একদলীয় সরকারব্যবস্থা কেন্দ্র থেকে শুরু করে একদম গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আবার কী খেয়াল হলো, তারা দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার ঘোষণা দিল। এই খেয়ালের কারণ কী? এবারের জাতীয় নির্বাচনে আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ বা নৌকা বনাম ডামি বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সবাই ঘরের লোক। ফলে এই নির্বাচনে যিনিই জিতেছেন, আওয়ামী লীগ বলতে পেরেছে, সেটা তাদেরই লোক।

স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতীকের বাইরে নির্বাচন করার পেছনে এই উদ্দেশ্য কাজ করছে কি না, সেটা বোঝা যাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফলের ওপর। এই ফলাফল যদি একতরফা হয় তাহলে বুঝতে হবে, জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা যে কৌশল নিয়েছিল, সেই একই কৌশল স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে তারা প্রয়োগ করছে।

বিএনপির অনেক ভোটার ও সমর্থক আছেন। অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের দাপট ও পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে তাদের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বা আত্মগোপনে আছেন, অনেকে আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে তাঁরা যদি আবার মাঠে নামেন, তাহলে বিএনপিকে আবার পুনর্জীবিত করা সম্ভব হবে। এর ফলটা বিএনপির পক্ষেই যাবে। জাতীয় পর্যায়েও বিএনপি এর ফল পাবে।

দুই.

বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর যে জাতীয় সংসদ হয়, সেখানে বিএনপি লাগাতার বর্জন করে। তাদের দাবি ছিল, একটা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন। কিন্তু বিএনপির এই দাবি মানা হয়নি। সে জন্য তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপি ফিরে এসেছিল। কিন্তু ২০২৪-এর নির্বাচন তারা বর্জন করেছে।

২০১৫ সালের পর স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির অনেক নেতা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অন্য প্রতীকে অংশ নিয়েছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যঁারা নির্বাচন করেছিলেন, বিএনপি তঁাদের বহিষ্কার করে। তবে আওয়ামী লীগ এ প্রশ্নে অনেক বেশি কৌশলী। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ নির্বাচন করলে তঁাকে বহিষ্কার করে ঠিকই, কিন্তু জিতলে আওয়ামী লীগে তাঁকে দলে নিয়ে নেয়। কিন্তু বিএনপি সেটা করেনি। এর ফলে বিএনপি অনেক জায়গায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এবার যতটুকু আভাস পাওয়া যাচ্ছে, দলীয় প্রতীকের বাইরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে, সেখানে বিএনপি অংশ নিতে পারে; অর্থাৎ দলের কেউ যদি নির্বাচন করেন, বিএনপি তাঁদের বাধা দেবে না, বহিষ্কার করবে না। এটা হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এলে ভোটারের অংশগ্রহণও বাড়বে।

সব দিক বিবেচনায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে তাদের কৌশল হওয়া উচিত, তারা যে নির্বাচনে অংশে নিচ্ছে, সেটা আগে থেকেই ঘোষণা করে দেওয়া। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রার্থীদের অনেক ধরনের প্রস্তুতি দরকার হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির একটা জোয়ার উঠতে পারে।

বিএনপির অনেক ভোটার ও সমর্থক আছেন। অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের দাপট ও পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে তাদের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বা আত্মগোপনে আছেন, অনেকে আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে তাঁরা যদি আবার মাঠে নামেন, তাহলে বিএনপিকে আবার পুনর্জীবিত করা সম্ভব হবে। এর ফলটা বিএনপির পক্ষেই যাবে। জাতীয় পর্যায়েও বিএনপি এর ফল পাবে।

বিএনপির কৌশল হওয়া উচিত ভোট বর্জনের মতো জনবিচ্ছিন্নতার পথে না গিয়ে জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করার বড় পদক্ষেপ হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তবে জাতীয় রাজনীতির অ্যাজেন্ডা-সর্বস্ব প্রচার না করে স্থানীয় সমস্যাগুলো তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে।

● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক