কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণপদযাত্রা। ১৪ জুলাই
কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণপদযাত্রা। ১৪ জুলাই

মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়: যেখান থেকে আন্দোলন শুরু, সেখান থেকেই শুরু হোক সংস্কার

নতুন ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। মূলত ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমেই বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর নানা ধাপ পার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে মুক্তিকামী বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা।

পুরো আন্দোলনের সূচনা হয়েছে শিক্ষাঙ্গন থেকে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দেশের ছাত্ররা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। যে কারণে তাঁরা এমন একটি বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিজয়ের পর শুরু হয়েছে প্রকৃত বিজয় অর্জনের কঠিন পথচলা। এই পথচলা কখনোই মসৃণ হবে না। কারণ, পুরো পথেই কাঁটা বিছানো আছে।

দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, সেই জঞ্জাল চাইলেও এক দিনেই মুছে ফেলা যাবে না।

তবে কিছু বিষয়ে জঞ্জালগুলো বোধকরি খুব দ্রুতই মুছে ফেলে সামনে এগোতে হবে। নাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা আছে। বিচার বিভাগ যেমন এর মধ্যে একটি। জনপ্রশাসন, পুলিশ বিভাগ যেমন আছে; ঠিক তেমনই শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে, এর একটি নির্দেশনা থাকা খুবই প্রয়োজন।

হাসিনা সরকারের নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। এটি হওয়ারই কথা ছিল।

কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে যেভাবে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে, এতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন স্বৈরাচারের সাহায্যকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ। সে ক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় যেন নিয়োগ দেওয়া না হয়। বরং এই নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে আগামী বছরগুলোয় কোন জায়গায় দেখতে চান এবং এর জন্য তিনি কী কী কর্মপন্থা অবলম্বন করবেন।

এর একটা নির্দেশনা দিয়েই তাঁকে উপাচার্য পদে আসীন হতে হবে।

যাঁকেই উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁকে কেন নিয়োগ দেওয়া হলো, কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হলো, তিনি কী করতে চান, পুরো বিষয়টি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেখতে হবে। না হলে এ নিয়ে বিতর্ক ওঠা খুবই স্বাভাবিক।

নতুন উপাচার্যদের প্রথম কাজই হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি (লেজুড়বৃত্তি) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। এই অপরাজনীতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণ ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম কাজই হওয়া উচিত ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।

এরপর বিভিন্ন প্রশাসনিক পদগুলো, বিশেষ করে প্রোক্টর, প্রভোস্টসহ অন্যান্য পদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা অবলম্বন করা হয়। কোনো রকম রাজনৈতিক বিবেচনা যেন সেখানে করা না হয়। যোগ্যতার ভিত্তিতেই যেন নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার সঠিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকেরা যাতে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেন, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ ছাত্ররা প্রতিটি কোর্স শেষে তাঁদের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করবেন, তাঁরা কেমন পড়িয়েছেন, আন্তরিক ছিলেন কি না, এসব বিষয়। পশ্চিমা দেশগুলোয় এটি বহুল প্রচলিত একটি চর্চা।

কোনো শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক অথবা প্রশাসক যদি কোনো প্রকার অন্যায় কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন; তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। প্রয়োজনে শাস্তি দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেন সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত হয় এবং ছাত্রছাত্রীরা যেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা পান, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে যেন একটা চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে, সে জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনে সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মধ্যে বিশাল দূরত্ব আছে। দূরত্ব বিশাল হলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখবেন কী করে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। প্রশ্ন করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীর একটি বিশাল অংশ পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। ছয় মাস কিংবা এক সেমিস্টারের জন্য শিক্ষার্থীরা যেন বিদেশে গিয়ে পড়ে আবার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারেন সে ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ দেওয়া উপাচার্যকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা অনার্স কিংবা মাস্টার্স করা অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। নিজেদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাতে পর্যাপ্ত গবেষণার পরিবেশ থাকে এবং গবেষণার জন্য যেন আলাদা বাজেটের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া ব্যাচেলর পর্যায়ে সব ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা যেন ব্যাচেলর থিসিস কিংবা প্রজেক্ট করতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাস্টার্সের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে। সব শিক্ষার্থী যেন এই সুযোগ পান

সর্বোপরি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। যেখানে শিক্ষার মান যেমন ভালো হবে।

ঠিক তেমন গবেষণার মানও বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা এবং গবেষণায় মন দেবেন।

এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি না করে পড়াশোনা করবেন। শিক্ষকেরা নীল-সাদা দলে ভাগ না হয়ে গবেষণায় মনোযোগ দেবেন। সেই সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

  • আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo. com