নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। সঙ্গে স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প
নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। সঙ্গে স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প

মতামত

হয় ফ্যাসিবাদ নয়তো জায়নবাদকে বেছে নিতে হবে

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফ্যাসিবাদ নিয়ে একের পর এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে দীর্ঘতম সময় ধরে দায়িত্বে থাকা চিফ অব স্টাফ জন কেলি বলেছেন, তিনি মনে করেন, ট্রাম্প ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার মধ্যে পড়েন।’ তাদের আরেকটি নিবন্ধে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, ‘এটি কি ফ্যাসিবাদ?’

খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রবার্ট প্যাক্সটন একসময় ট্রাম্পের ওপর এই তকমা লাগানোকে ফ্যাসিজমের অতিরঞ্জিত ব্যবহার বলে মনে করতেন। কিন্তু ‘ট্রাম্পিজম’-এর মুখোমুখি হয়ে তিনি তাঁর মত বদলেছেন।

নিবন্ধের পর নিবন্ধ পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ট্রাম্প ‘মূলত ফ্যাসিস্ট’। তাদের একটি শিরোনামে বলা হয়েছে: ‘কমলা হ্যারিস এবং ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলার বিষয়ে আর দ্বিধাগ্রস্ত নয়।’

২০২৪ সালের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এটি একটি জাতীয় উৎসবমুখর উপলক্ষ। এই নির্বাচনে কোটি কোটি হতাশাগ্রস্ত বা বিভ্রান্ত আমেরিকানকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোন ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশা করছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোনটিকে বেছে নেবেন; ফ্যাসিবাদ নাকি জায়নবাদ?

‘রেকর্ডের কাগজ’ দেখে মনে হচ্ছে, তাদের কথাই ঠিক। অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প একজন ফ্যাসিস্ট এবং সুযোগ পেলে তিনি এই দেশকে মুসোলিনির ইতালি, হিটলারের জার্মানি এবং ফ্রাঙ্কোর স্পেনে পরিণত করবেন।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই একই পত্রিকায় আপনি গত ১৩ মাস ধরে ফিলিস্তিন ও লেবাননে যে গণহত্যা ঘটে চলেছে তার একটি ঘটনাও (ঘটনাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ বা খারিজ করার ক্ষেত্র ব্যতীত) খুঁজে পাবেন না।

ফিলিস্তিন ও লেবাননে চলা ধ্বংসযজ্ঞের জন্য যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মূলত দায়ী, সে কথা তাদের প্রতিবেদনের কোথাও খুঁজে পাবেন না।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস আমেরিকানদের ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে সতর্ক করে যাচ্ছে। কিন্তু বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েলের গণহত্যামূলক ইহুদিবাদ নিয়ে কোনো উল্লেখ তাদের প্রতিবেদনে পাবেন না।

২০২৪ সালের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এটি একটি জাতীয় উৎসবমুখর উপলক্ষ। এই নির্বাচনে কোটি কোটি হতাশাগ্রস্ত বা বিভ্রান্ত আমেরিকানকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোন ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশা করছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোনটিকে বেছে নেবেন; ফ্যাসিবাদ নাকি জায়নবাদ?

কিছুদিনের মধ্যেই হ্যারিস কিংবা ট্রাম্প তাঁদের নিজ দেশে (এবং বিশ্বের) সবচেয়ে সহিংস নির্বাচিত দপ্তরটি দখল করবেন। এই দুই প্রার্থীর মধ্যে একজন শিগগিরই সেই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা হাতে পাবেন যা বর্তমানে বাইডেনের মতো একজনের হাতে রয়েছে।

প্রায় এক বছর ধরে স্বপ্রকাশিত জায়নবাদী বাইডেন সামরিক সরঞ্জাম, কূটনৈতিক কূটকৌশল, মিথ্যার চটক এবং যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রহসনের মাধ্যমে একটি জাতিকে নির্বিঘ্নে ধ্বংস করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ইসরায়েলের সবচেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মদদ দিয়েছেন।

বাইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে মিথ্যে বলে বলে তাঁর সহযোগী জায়নবাদীদের গণহত্যা চালাতে সাহায্য করছেন। তিনি হেনরি কিসিঞ্জারের চেয়েও নির্মম মিথ্যাবাদী হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাইডেনের পূর্বসূরি ট্রাম্প প্রকাশ্য এবং নগ্ন বর্ণবাদের মাধ্যমে আমেরিকান সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্তর্নিহিত আচ্ছাদন খুলে দিয়েছেন।

এখন দেখা যাচ্ছে, বাইডেনের প্রতিরূপ কমলা হ্যারিস তাঁর পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করতে প্রস্তুত আছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প আগের চেয়েও খারাপ আচরণ করতে প্রস্তুত। এ কারণে প্রশ্ন উঠছে, এই দুই বড় মন্দের মধ্যে কোনটিকে ভোটাররা বেছে নেবেন।

এই দুই প্রার্থী বিশ্বে যে ক্ষতি ডেকে আনবেন তার কোনো পরিমাপ হয় না। তাঁরা উভয়ই নির্মম সহিংসতার ক্ষমতা রাখেন; যেমনটি ইসরায়েল এখন ফিলিস্তিন ও লেবাননে করে চলেছে। তাঁরা উভয়েই আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবশিষ্টাংশকে ধ্বংস করছেন। তাঁরা মূলত তাঁদের বলয়ে থাকা ধনকুবের ক্লাবের কয়েকজন সদস্যের ব্যক্তিগত লাভের জন্য আমাদের ভাগ্যকে বিপন্ন করে তুলেছেন।

প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ যোগ্য আমেরিকান ভোটার সাধারণত কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন না। ভোট দেওয়া ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটার প্রায় সমানভাবে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটের মধ্যে বিভক্ত।

এই নির্বাচনে কোনো বিবেকবান মানুষ (সে আমেরিকান হোক বা না হোক) কোনো বাস্তব বিকল্প দেখতে পাচ্ছেন না।

আপনি যদি হ্যারিসকে ভোট দেন, তাহলে আপনি একটি পুরো জাতির বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যাকে সমর্থন করবেন। আর যদি ট্রাম্পকে বেছে নেন, তাহলে আপনি একজন দোষী সাব্যস্ত অপরাধীকে নির্বাচিত করছেন যার জাতিগত বিশ্ব আধিপত্য এবং দেশীয় ফ্যাসিবাদের রেকর্ড রয়েছে।

আমেরিকান নির্বাচনের সমস্যাটি হলো, যাঁরা এই সত্যগুলোকে অবহেলা করেন এবং এই দুটি মন্দের মধ্যে একটিকে বেছে নেন, তাঁরা সেই বাকি আমেরিকানদের বিপক্ষে দাঁড়ান যাঁরা শালীনতা রক্ষা করতে চান এবং বিশ্বকে আমেরিকান সামরিক বর্বরতার হাতে ছেড়ে দিতে চান না।

এই দেশের প্রচলিত ধারণা হলো, এখানে কোনো তৃতীয় দল; এ কারণে তাঁরা এখনো দ্বিতীয় দলের জন্য অপেক্ষা করছেন। অথচ বিদ্যমান দুটি দলই তাদের সামরিকবাদী মনোভাবে এবং ইসরায়েলি বসতি স্থাপন প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় অভিন্ন।

আসরে তাদের যেকোনো একজনের বিজয়ই মানবতার জন্য একটি মূর্তিমান দুর্যোগ। আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু হলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যা। আর এই ইস্যুতে যা ট্রাম্প, তা-ই হ্যারিস।  

  • হামিদ দাবাশি নিউ ইয়র্ক সিটির কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক

    মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত