রবীন্দ্রনাথ এখানে কৃষি দেখতে এসেছিলেন। সেই ১৯১২ সালে। সেখানে, ১৯০৬ সাল থেকে, আরবানা শ্যাম্পেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি-অর্থনীতি পড়তেন তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রবর্তন করেন, ট্রাক্টর ইত্যাদি নিয়ে যান, উন্নত কৃষির প্রয়াস চালান, এমনকি আজ যে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এলাকায় দুগ্ধশিল্পের পসার, তার পেছনেও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিতে লেখেন, ‘ভাই জ্যোতিদাদা, আমরা আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। সে কারণে তোমার চিঠি আসতে দেরি হয়েছে।...আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বৌমা সেই বাড়ির কর্ত্রী। তাকে নিজেই রান্না করতে হচ্ছে।’ চিঠির ওপরে ঠিকানা লেখা—‘৫০৮ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ’।
সেই ১৯১২ সাল থেকে এখন ২০২৩ সাল—১১১ বছর। বার্তা পেলাম, আমেরিকার ইলিনয়ের ডেকাটুরে ২৯-৩১ আগস্ট কৃষি প্রদর্শনী হবে, দেখতে যেতে পারব কি না! সেই শিকাগো, সেই ইলিনয়, সেই কৃষি, সেই রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ডাক কোনো বাঙালি লেখক উপেক্ষা করতে পারে! যে বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদের প্রুফ দেখেছিলেন এবং নোবেল পুরস্কার পেলেন। শিকাগোর পত্রিকায় বেরোয় তাঁর কবিতার অনুবাদ।
সামনে মেরিল-প্রথম আলো। হাল ধরেছেন কবির বকুল ও তারিক আনাম ভাই। তাঁরা গাইছেন, ‘না যেও না...’ আমি বললাম, ‘দুই রাতের জন্য আমি একটু আসছি।’ একটা ছোট্ট ব্যাগ হাতে নিয়ে বললাম, ‘চললাম।’ এরপর সোজা বিমানবন্দর।
শিকাগো থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো আরবানা-শ্যাম্পেন শহরে। এ শহরেই রবীন্দ্রনাথ এসে উঠেছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ সালে পোস্ট করা এ চিঠিতে কবি লেখেন, ‘আর্ব্বানায় যখন ছিলুম, তখন একদিন রাত্রে খুব বৃষ্টি হয়ে গিয়ে সেই বৃষ্টির জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল...।’ আমরা যখন হাজির হয়েছি, তখন ঝকঝক করছে রোদ। আমাদের সঙ্গে আছেন ইউসেকের দুজন কর্মকর্তা, আর ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চার সাংবাদিক। কৃষি প্রদর্শনী তো দেখবই, আমি বললাম, আমাকে অবশ্যই ৫০৮ হাই স্ট্রিটে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন, কাগজের খবর অনুসারে, বাড়িটা এখন দুজন ভারতীয় বাঙালি কিনে নিয়েছেন রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্র করবেন বলে।
আমি আদার ব্যাপারী। সয়াবিনের কী বুঝব। ভাবছি, রবীন্দ্রনাথ এখানে কৃষি দেখতে এসেছিলেন, আমিও তা-ই করলাম। এতে সরিষা পরিমাণ জ্ঞান পেলাম, তিলকে তাল করে লিখতেও পারব, কিন্তু মিস্টার বিন তো হতে পারব না। বিনের ব্যাপারটা বাংলাদেশের কর্তা, উদ্যোক্তা আর ব্যবসায়ীরাই ভালো বুঝবেন। ইউসেককে ধন্যবাদ, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে দেওয়ার জন্য।
সেই বাড়ির সামনে আমাদের মাইক্রোবাস দাঁড়াল এক সোনাঝরা বিকেলে। অন্যদের গাড়িতে রেখে আমি বাড়ির সিঁড়িতে পা দিলাম। বাড়িতে কেউ নেই। সাহস করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। আমেরিকান আর সাতটা বাড়ির মতোই কাঠের তৈরি একতলা বাড়ি। ঘরদোর-রান্নাঘর ঘুরে বেরিয়ে এলাম। কেউ স্বাগতও জানাল না, কেউ বাধাও দিল না।
এবার বলি, আমেরিকার কৃষি সম্পর্কে যা দেখেছি, যা জেনেছি, তা ভয়াবহ রকমের বিস্ময়কর, অভাবিতপূর্ব। একটা কৃষিখামার দেখতে গিয়েছি। মালিক নিজেই চাষ করেন। কত একর জমি চাষ করেন, কল্পনা করতে পারেন? আড়াই হাজার একর। কজন মানুষ? মোট চারজন—ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী, একজন কর্মচারী ও তাঁর স্ত্রী। ওই কর্মচারীর বেতন কত? বছরে বাংলাদেশি টাকায় ছয় কোটি টাকা। একজন অধ্যাপকের বেতনের ছয় গুণ বেশি। এ কারণে তাঁরা বলছিলেন, পাঁচ হাজার একর যদি চারজনে চাষ করতেন, তাহলে পোষাত। আড়াই হাজার একরে চারজন, লোক বড্ড বেশি! হায়, বাংলাদেশে ৬০ বিঘার বেশি কারও কৃষিজমিই থাকতে পারবে না।
কী করে সম্ভব চারজনে হাজার হাজার একর জমি চাষ করা! সবকিছুই যন্ত্রে করা হয়। বিশাল বিশাল ট্রাক্টর, বীজ বোনার যন্ত্র, সেচের যন্ত্র, ফসল কাটার যন্ত্র। একেকটা যন্ত্রের চাকা আমার উচ্চতারও দ্বিগুণ। অনেক ক্ষেত্রে চাষিকে মাঠেও যেতে হয় না। তিনি ভিডিও গেমসের মতো ঘরে বসে রিমোটে চাপ দিচ্ছেন, আর এই দৈত্যকার যন্ত্রগুলো চাষ করছে, বীজ বুনছে, ফসল কাটছে, ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। কৃষক এই হাজার একর নিজের চোখে দেখতে যান না, যাওয়া অসম্ভব। অ্যাপ বলে দিচ্ছে, কোন জায়গায় কী লাগবে। সবই করে দিচ্ছে জিপিএস।
তাহলে প্রদর্শনীতে আমরা কী দেখলাম! ট্যাংকের চেয়ে বড় বড় কৃষিযন্ত্র। যা দেখলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, আর আমাদের দু-চার কাঠা জমিতে তার প্রয়োগের চিন্তা আমি করতেও পারছি না। শুধু ভাবছি, প্রযুক্তি এত এগোলে মানুষ কি সত্যিই বেকার হয়ে পড়বে, নাকি এরই মধ্যে বেকার হয়ে গেছে!
আমাদের মেজবান ইউসেক, আমেরিকার সয়াবিন রপ্তানিকারক পরিষদ। তাঁদের প্রকাশনা সূত্রের তথ্য, বাংলাদেশ ৪ নম্বর সয়াবিন তেল আমদানিকারক। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম মৎস্য উৎপাদক। মাছের খাদ্য হিসেবে সয়াবিনের দানা লাগে। পোলট্রিতেও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সয়াবিন আমদানির দেশ। পোলট্রিতে এবং মাছের খাদ্য হিসেবে সয়াবিন ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশ তেলও বানায়। পত্রিকান্তরে খবর, বাংলাদেশ ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন সয়াবিন এ বছর আমদানি করবে; সবচেয়ে বেশি আমদানি করে ব্রাজিল থেকে, এরপর আছে আমেরিকা ও আর্জেন্টিনা। এ সূত্রে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ বিন আমদানিতে পৃথিবীর ১৩ নম্বর দেশ।
আমেরিকার শিকাগোতে ফিরে এসে আবারও চললাম তীর্থদর্শনে। বাংলাদেশি আমেরিকান প্রকৌশলী এফ আর খানের সেই বিখ্যাত উইলিস টাওয়ার, আগে যা ছিল সিয়ারস টাওয়ার, ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন, তা দেখতে। ৩৩ ডলারে অনলাইনে টিকিট করে উঠে পড়লাম ১০৩ তলা ভবনের সর্বোচ্চ তলায়। ওখানে একটা কাচ আছে দেয়ালের বাইরে, যার ওপরে দাঁড়ালে নিচের মাটি দেখা যায়। বছর ১৩ আগে যখন এই ১০৩ তলায় এসেছিলাম, তখন ভয়ে কাচের ওপরে উঠিনি। এবার সাহস করে উঠেই পড়লাম। ফজলুর রহমান খান সাহেব এত বড় ভবন বানাতে পারবেন, আর আমি একটা কাচের ওপর দাঁড়াতে পারব না।
এফ আর খান বলেছিলেন, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে। আর জীবন হলো, শিল্প, সংগীত, নাটক এবং সবচেয়ে বড় কথা মানুষ।’
দ্রুতই ফিরে এলাম ঢাকায়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম দিকের যাত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করলাম। এফ আর খান বলেছেন, নাটক, গান, আর্ট উপভোগ করতে। তা-ই উপভোগ করতে চললাম মেরিল-প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে।
এফ আর খান আরও বলেছেন মানুষের কথা ভাবতে। ভাবছি। যন্ত্র সব করতে থাকলে মানুষ করবে কী! আর মনে পড়ছে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে একটা কথোপকথন, বাংলাদেশ হাজার কোটি টাকা তেল আমদানিতে খরচা করে। দুই শস্যের ফাঁকে শর্ষে করা যায়। আমরা সেই উদ্যোগ নিচ্ছি।
তবে পোলট্রি আর মাছ চাষে বিন লাগবেই। বাংলাদেশের ওপরে আমেরিকান রপ্তানিকারকেরা খুব খুশি। কারণ, বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে বিন আমদানি করে।
আমি আদার ব্যাপারী। সয়াবিনের কী বুঝব। ভাবছি, রবীন্দ্রনাথ এখানে কৃষি দেখতে এসেছিলেন, আমিও তা-ই করলাম। এতে সরিষা পরিমাণ জ্ঞান পেলাম, তিলকে তাল করে লিখতেও পারব, কিন্তু মিস্টার বিন তো হতে পারব না। বিনের ব্যাপারটা বাংলাদেশের কর্তা, উদ্যোক্তা আর ব্যবসায়ীরাই ভালো বুঝবেন। ইউসেককে ধন্যবাদ, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে দেওয়ার জন্য।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক