রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তামাশা শুরু হয়েছে আবার। সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় মোট ৭ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
গত মার্চ মাসে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে এবং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে। বাংলাদেশ সরকার চাইছে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও ছোট একটি দলকে রাখাইনে পাঠিয়ে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হোক। বাংলাদেশকে এ নিয়ে তাগাদা দিচ্ছে চীন (রাহীদ এজাজ, প্রথম আলো ২৫ আগস্ট ২০২৩)। গত ২৭ মে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-চীন পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করতে বলে চীন।
২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার মুখে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ওই বছরেরই নভেম্বরে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই অসম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পালিয়ে আসা ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে। ‘যাচাই-বাছাই’-এর পর তা থেকে ৬২ হাজার ২৮৫ ব্যক্তিকে ‘ক্লিয়ার’, অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে আগত বলে নিশ্চিত করে মিয়ানমার। এই সংখ্যা মিয়ানমারকে দেওয়া তালিকার ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ মাত্র। বলা বাহুল্য, এই চুক্তির অধীন গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হয়নি।
স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবসিত করার এটি তৃতীয় প্রয়াস। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে বৈঠকে পরের মাসে সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেওয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে বিরাজমান পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর বিরোধিতা করে।
জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান তখনো রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যা চলমান বলে মতপ্রকাশ করেন। তালিকাভুক্ত শরণার্থীদের আপত্তির মুখে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর প্রায় এক বছর পর ঢাকায় এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আবার প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের দেওয়া ২২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা থেকে ৩ হাজার ৫৪০ জনকে ‘ক্লিয়ার’ করে মিয়ানমার এবং ২০১৯ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে তাঁরা প্রত্যাবাসিত হবেন বলে ঘোষণা করা হয়। আগেরবারের মতোই তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের অসম্মতির কারণে এ প্রয়াস সফল হয়নি।
ছোট একটি প্রত্যাবাসন যদি সম্ভব হয়ও, তা রোহিঙ্গাদের বা বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে না। এটা কাজে লাগবে মিয়ানমারের, তাদের জন্য এটা একটা প্রচারের অস্ত্র হবে এবং বিশ্বসম্প্রদায়কে তারা দেখাতে পারবে যে দ্বিপক্ষীয় (বা ত্রিপক্ষীয়) ভাবেই তারা সমস্যার সমাধান করে ফেলতে সক্ষম। এ কাজে তাদের সহায়তা করবে চীন, রাশিয়া এবং হয়তো ভারতও, যারা বরাবর গণহত্যাকারী মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই। ‘পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে’ কিছু সমস্যা আবিষ্কৃত হবে অবশ্যই এবং সেসব নিরসনের আলোচনায় আরও অনেক বছর পার করে দিতে পারবে মিয়ানমার। এ ছাড়া পরিচয় নিরীক্ষা করার ব্যাপার তো থাকছেই।
বাংলাদেশ কেন এই ফাঁদে পা দিচ্ছে, তা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে কারও বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়। এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসন বড় আকারে প্রত্যাবাসনের আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং বুঝতে সহায়তা করবে।
এখানে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এক, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মূল সমস্যা হচ্ছে রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশের অভাব। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব মিয়ানমারের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। সে পরিবেশ কি তারা সৃষ্টি করেছে? এই পরীক্ষাগারে তাহলে কী বোঝার চেষ্টা করা হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বড় আকারে প্রত্যাবাসনের কোনো রোডম্যাপ কি তৈরি করা হয়েছে? এরূপ একটি রোডম্যাপ সামনে রেখে হয়তো পরীক্ষামূলক বা পাইলট প্রকল্প তৈরি করলে সেটায় কিছু যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত। এটা ঠিক যে প্রত্যাবাসন শুরু হলে চীন খুশি হবে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ পদক্ষেপকে সমর্থন করবে না। নিজেদের স্বার্থ পরিপন্থী পদক্ষেপ নিয়ে চীনকে খুশি করা কি এতই জরুরি?
এদিকে প্রত্যাবাসন নিয়ে আরেক অবাস্তব প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে আমাদের মার্কিন বন্ধুরা। প্রথমেই বলে রাখি, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা এসেছে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই। আর বর্মি সামরিক জান্তার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খানিকটা চাপ সৃষ্টির প্রয়াসও দেখা গেছে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের সার্বিক উৎখাত পর্বের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে মার্কিন দূতাবাস একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
এতে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত, মিয়ানমারে বিরাজমান পরিস্থিতিতে তাদের সে দেশে ফেরত যাওয়াকে অনিরাপদ মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের এ বক্তব্য সঠিক। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবে বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশে তাদের পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৪ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা পুনর্বাসিত হয়েছে, এ তথ্যও জানানো হয়েছে। এর আগে গত ১৪ আগস্ট ১১ সদস্যবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল উখিয়া শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। সেখানে রোহিঙ্গারা তাঁদের ওপর মিয়ানমার সেনাদের নিপীড়নের বিবরণ দেওয়ার পাশাপাশি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যার তুলনায় ১৪ বছরে ১৩ হাজার পুনর্বাসন সমুদ্রে বিন্দুবৎ। গত বছর আমি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুজনকে দেখলাম ছোট ব্যবসা করে সুন্দর জীবন যাপন করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের যত জায়গায় গিয়েছি, দোকানপাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য পোস্টার দেখেছি—‘উই আর হায়ারিং’। স্বল্প বেতনে ছোটখাটো চাকরির বিপুলসংখ্যক পদ খালি, লোক পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি এক মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে যায়, তাৎক্ষণিক পাঁচ লাখ কর্মী পেয়ে যাবে, যারা এসব ছোটখাটো কাজে লেগে যেতে পারবেন। কালক্রমে এই মানুষগুলো এবং তাদের সন্তানেরা কর প্রদানকারী ভোক্তায় পরিণত হবেন, যা মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
পাশাপাশি মানবিকতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব নীতিকথা প্রচার করে, বাস্তবেও যে তাতে বিশ্বাস করে, তারও প্রমাণ দেওয়া হবে এবং বিশ্বসমাজে মার্কিন ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তুলনায় অনেক ছোট দেশ জার্মানি ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাঁদের ৭০ শতাংশ এরই মধ্যে জার্মান অর্থনীতিতে মসৃণভাবে আত্তীকৃত হয়েছে। জার্মানির কোনো ক্ষতি হয়নি এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলে বরং তার ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এ কাজ করবে, তা প্রত্যাশিত নয়। সে ক্ষেত্রে অনর্থক তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের ধ্বজা তুলে শরণার্থীদের মধ্যে প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়ে লাভ নেই। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই নিহিত। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের বন্ধু এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরিতে বরং সে তার ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রয়োগ করুক। আর এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অর্থের সংস্থান করুক যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব