মালি থেকে কেন শান্তিরক্ষীদের সরতে হলো

শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে জাতিসংঘ ও মালির সামরিক জান্তার মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে টানাপোড়েন চলছিল। ২০২১ সালে মালি রাশিয়ার ভাগনার গ্রুপের সঙ্গে মিত্রতা করার পর থেকেই শান্তিরক্ষীদের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছিল সরকার। গত শুক্রবার আফ্রিকার দেশ মালিতে শান্তি রক্ষা মিশনের সমাপ্তি ঘোষণা করে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় দেশটির সম্ভাব্য পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করেছে বিবিসি।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ২০১৩ সালে শান্তি রক্ষা কার্যক্রম শুরু করে জাতিসংঘ। প্রায় ১০ বছর পর নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সেই কার্যক্রম সমাপ্তির ঘোষণা এল গত শুক্রবার। এই এক দশকে ৩০০ শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন।

গত বছর মালির নিয়ন্ত্রণ নেয় সামরিক নেতৃত্ব। এরপর দেশটি থেকে ফ্রান্স তার সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। মালি একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ইতিমধ্যে মালির সামরিক নেতৃত্ব দেশটিতে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের নিয়ে যায়। ভাগনারের এক হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে মালিতে।

কেন মালিতে শান্তিরক্ষী পাঠিয়েছিল জাতিসংঘ

২০১৩ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা ও ইসলামের নাম করে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে হাত মেলায়। তারা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মালির উত্তরাঞ্চলের দখল নিয়ে নেয়। সেখানে তারা পৃথক এক দেশ গঠন করতে চেয়েছিল। এ অবস্থায় জাতিসংঘ দেশটিতে শান্তি রক্ষা মিশনের যাত্রা শুরু করে। এর আগেই দেশটির নানা গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান ঠেকাতে মালিতে পাঁচ হাজার সেনা পাঠিয়েছিল ফ্রান্স।

অনেক বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের হুমকিতে রয়েছে মালি। তারা হাজারো মানুষকে হত্যা করে, তাদের কারণে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।  মালিসহ আশপাশের বিস্তৃত এলাকায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (বৃহত্তর সাহারা) ও আল-কায়েদার অধিভুক্ত জামাত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন বহুদিন ধরেই সক্রিয়।

তারা একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে। প্রতিবেশী বুরকিনা ফাসোতে সক্রিয় রয়েছে আরেক জঙ্গিগোষ্ঠী, আনসারুল ইসলাম। আর প্রতিবেশী দেশগুলোতে তৎপর বোকো হারাম।

শান্তি রক্ষা মিশন কি সফল

শান্তিরক্ষী ও ফরাসি সেনাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মালিতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নিজেদের পক্ষে দেশটির নাগরিকদের টানতে তৎপরতা জোরদার করেছে।

গত এক দশকে মালিতে জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক শান্তিরক্ষী। এই মিশন  সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী প্রাণঘাতী মিশন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

দেশটিতে জাতিসংঘের এই মিশন নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছে চীন ও রাশিয়া। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও সুইডেন তাদের কোনো সেনাকে মালিতে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গত বছর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ফরাসি সেনা প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন।

২০২১ সাল থেকে ক্ষমতা দখল করে থাকা সেনা নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। কেননা, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে পরিকল্পনার কথা তারা বলেছিল, তা বারবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে নিরাপত্তা দিতে তারা ভাগনার গ্রুপকে ডেকে নিয়েছে। 

সম্প্রতি ভাগনার যোদ্ধারা রাশিয়ার সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে একপর্যায়ে সেটা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন বেলারুশে গেছেন। এ পটভূমিতে এটা অস্পষ্ট যে মালিতে ভাগনার সেনাদের উপস্থিতি আরও বাড়বে, নাকি যাঁরা আছেন, তাঁরাও ফিরে যাবেন।

তবে মালির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অস্থির হয়ে ওঠা মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের মানুষ হয়তো শান্তিরক্ষীদের অভাব অনুভব করবে। এরই মধ্যে সেনাশাসকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে তারা। শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতি অন্তত চুক্তিটিকে (তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ মালিতে থাকার) বাঁচিয়ে রাখতে পারত। শান্তিরক্ষীদের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশ হয়তো আবারও কার্যত জঙ্গি বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

মালি কেন চায় শান্তিরক্ষীরা চলে যাক

মালি জাতিসংঘকে বলেছিল, সব শান্তিরক্ষীকে মালি ছেড়ে যেতে হবে। মালিতে শান্তিরক্ষীদের অবস্থানের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আরও এক বছরের জন্য শান্তিরক্ষীদের মালিতে থাকার বিষয়টি সুপারিশ করেছিলেন।

তবে মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদোলায়ে দিওপ ওই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, মালিতে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলায় জাতিসংঘের বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন মালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তুলেছে, যা শান্তি, ঐক্য ও দেশের পুনর্গঠনের জন্য বাধা।’

গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘ। তাতে বলা হয়, ২০২২ সালের মার্চে মালির মধ্যাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় মালির সেনাবাহিনী ও বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধারা ৫০০ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী অভিযোগ করে, তাদের অভিযানে প্রায়ই হস্তক্ষেপ করে মালি সরকার।

এ পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আগামী ছয় মাসের মধ্যে মালি থেকে শান্তি রক্ষা মিশন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়।

ভাগনারের উপস্থিতি বাড়লে কতটা মূল্য দিতে হবে

শান্তিরক্ষী বাহিনীর মালি থেকে চলে যাওয়া মানে দেশটি ভাগনার গ্রুপের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। মালির উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। ভাগনার গ্রুপের ভীতিজাগানিয়া কর্মকাণ্ডের কথা কারও অজানা নয়। তবে এরপরও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরও বেশি যোদ্ধা মালিতে গিয়ে ভাগনারের শক্তি বৃদ্ধি করলেও প্রশ্নটি হারিয়ে যাবে না।

সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভাগনারপ্রধান প্রিগোশিনের বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কোন ধরনের ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ভাগনার সেনাদের মালিতে মোতায়েন করা হবে?

মালিতে ভাগনার সেনাদের উপস্থিতি মানে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা একধরনের খচখচানি—রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিষয়টিকে এভাবেই দেখবেন। পাশাপাশি একে পশ্চিম আফ্রিকায় রাশিয়ার উপস্থিতি হিসেবেও দেখবেন তিনি।  

কিন্তু ভাগনারের বিমান হামলার তেমন সক্ষমতা নেই। পদাতিক বাহিনী এবং লজিস্টিক বা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে সহযোগিতা দেবে তারা, যেমনটা দিত ফরাসি বাহিনী।

ভাগনার গ্রুপ খুব সম্ভবত মোটের ওপর কৌশলগত সার্বিক সক্ষমতা প্রয়োগের চেয়ে প্রধান কিছু সামরিক ঘাঁটিতে থাকার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে। যেখান থেকে তারা অভিযান পরিচালনা করতে পারবে এবং টহলে বের হতে পারবে।

ফরাসি বাহিনী চলে যাওয়ার পর গত ১১ মাস ভাগনারের ওপর নির্ভর করেছে মালি। তবে এই সময়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে এবং হামলার পরিধি বিস্তৃত করেছে।

শান্তিরক্ষীরা চলে গেলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এই তৎপরতা আরও বাড়তে পারে বলেই প্রতীয়মান হয়। ভাগনারের কঠোর অবস্থান তুয়ারেগ ও পেউল (ফুলানি) সম্প্রদায়ের মধ্যে আবারও বিভেদ তৈরি করতে পারে।

কৃষিকাজ ও পশু পালনে জড়িত দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এমনিতেই উত্তেজনা রয়েছে। এরই মধ্যে যা মালির মধ্যাঞ্চলের সহিংসতায় জ্বালানি ঠেলে দিয়েছে। অথচ নিগার নদীর উর্বর এই বদ্বীপ হতে পারে পশ্চিম আফ্রিকার ‘চালের ঝুড়ি’।

এরই মধ্যে নিরাপত্তার অভাবে দেড় হাজারের বেশি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতি ব্যাপক মার খেয়েছে। দেশটির উত্তরাঞ্চলের অনেক অংশেই মালি সরকারের প্রশাসনিক উপস্থিতি নেই। ওই সব এলাকার মানুষ জরুরি অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত।

বেসরকারি পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাকলেডের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের এ পর্যন্ত অন্তত ৬৮২টি ঘটনায় ১ হাজার ৫৭৬ জনের প্রাণ গেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থা বেশি খারাপ। ওই অঞ্চলের হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে ছোট্ট মরু শহর এম নাকার চারদিকে গড়ে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে নিতে হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন প্রত্যাহারে এই মানুষদের ভোগান্তি আরও বাড়বে বলেই প্রতীয়মান হয়।

যদিও মালির সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সফলতা পাওয়ার দাবি করেছে। তবে বাস্তবতা হলো তাদের টিকে থাকতে বেগ পেতে হচ্ছে। এমনকি রাজধানী বামাকোর চারদিকেও বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে।

মালির সামরিক শাসক কর্নেল আসিমি গোইতা সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকায় জাতিসংঘের বাহিনীকে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের বাহিনীর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট। চাইলেই তার বাইরে গিয়ে তারা কিছু করতে পারে না। যেমন জঙ্গি হামলা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া, মৌলিক কিছু সেবা ও মানবিক সহায়তা দেওয়ায় সহযোগিতা করা এবং ২০১৫ সালে সই হওয়া চুক্তিকে সমর্থন দেওয়া। এই চুক্তির অধীনে উত্তরের তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ঐক্যবদ্ধ মালিতে থাকার ব্যাপারে সম্মত হয়। বিনিময়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে, যাতে তৃণমূল পর্যায়ে তা পৌঁছে যায়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মালির প্রধানমন্ত্রী চোগুয়েল মা গা অভিযোগ করেন, তাঁর দেশকে ‘মাঝ আকাশে’ রেখে ফ্রান্স চলে যাচ্ছে। অথচ এর কয়েক মাসের মধ্যে দেশটি ভাগনারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

কর্নেল গোইতা মালিতে গণতন্ত্র পুনর্বহালে দেওয়া সময়সীমা বারবার বাড়াচ্ছেন। এ জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোর জোট ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইসিওডব্লিউএএস) ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ভাগনারের উপস্থিতির নিন্দা জানিয়েছে জোটটি। তারা মনে করে, বিষয়টি গোটা অঞ্চলের জন্যই হুমকি।

কর্নেল গোইতা এরই মধ্যে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আগামী বছরের নির্বাচন সেনা নেতৃত্বের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জাতিসংঘের চলে যাওয়ার অর্থ তিনি তাঁর লক্ষ্যের দিকে আরও চাপমুক্তভাবে এগোতে পারবেন।

তবে মালির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অস্থির হয়ে ওঠা মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের মানুষ হয়তো শান্তিরক্ষীদের অভাব অনুভব করবে। এরই মধ্যে সেনাশাসকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে তারা। শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতি অন্তত চুক্তিটিকে (তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ মালিতে থাকার) বাঁচিয়ে রাখতে পারত। শান্তিরক্ষীদের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশ হয়তো আবারও কার্যত জঙ্গি বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

  • ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ হাসান ইমাম