দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের মতো রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ন্যায্যতা প্রদর্শন এটিই প্রমাণ করে যে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বশক্তিগুলো, সেইসঙ্গে অন্যরাও। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ইতিহাসের ফরাসি, জার্মান এবং ব্রিটিশ শক্তির আগ্রাসন থেকে দেখা যায়, ভূ-রাজনৈতিক অহংকার মারাত্মকভাবে রাজনৈতিক মূর্খতাকে ত্বরান্বিত করে।
ইউক্রেন যুদ্ধে পরিস্থিতি রাশিয়ার বিপক্ষে মোড় নিলে, দ্রুত বিজয় অর্জনে যে স্বপ্ন দেখেছিল ক্রেমলিন, তা অর্জনে ব্যর্থতার জন্য ভ্লাদিমির পুতিনের অহংকারী মনোভাবকেই দায়ী করা যেতে পারে। এর পেছনে আছে তাঁর পাঁচটি মারাত্মক ভুল।
একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে অতিরিক্ত ধারণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সেই সঙ্গে রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষাকে ভুলভাবে বিবেচনা করেছেন তিনি। সামরিকভাবে পিছিয়ে থাকা কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রুর বিরুদ্ধে রাশিয়াকে এখন বাজেভাবে মূল্য দিতে হচ্ছে এবং সেইসঙ্গে সংঘর্ষে অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। ইউক্রেনীয়রা স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করছে এবং দেশের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যরা তাদের ইউনিট পরিত্যাগ করছে। নাগরিকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর রুশ পুরুষেরাও পালিয়ে যেতে শুরু করেছে।
পুতিনের অজ্ঞতাপূর্ণ দ্বিতীয় ধারণাটি হচ্ছে—তাঁর বিশ্বাস ছিল, হামলা চালানোর কয়েক দিনের মধ্যে কিয়েভ আত্মসমর্পণ করবে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীর মতোই তিনিও একই ভুল করেছেন। দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাদের অঙ্গীকারকে ছোট করে দেখেছিলেন তিনি। অভিন্ন ইতিহাসের কারণে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ ধরে নিয়েছিলেন। যদিও বেশির ভাগ ইউক্রেনীয়ই রুশ সাম্রাজ্যের অতীত থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছাপোষণ করে। ইউক্রেনীয়দের এমন স্বাধীন পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে পুতিনের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ইউক্রেনীয় দেশপ্রেম যেভাবে জেগে ওঠেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি এবং সেখানে পুরোপুরি সহায়তা করেছে পশ্চিমা সমর্থন।
ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তি নিয়ে অনুমান সঠিক ছিল না পুতিনের। তাঁর হিসাবে ছিল, পশ্চিমা নিরাপত্তার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে ন্যাটো এখন দুর্বল হয়ে গিয়েছে। তাই প্রাচ্যের কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া কিছুটা ধীর হবে।
পুতিন এও ধারণা করেছিলেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের প্রতি ইউরোপের নির্ভরশীলতার কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে। এখানেও তিনি ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। সাহসী ও আক্রমণাত্মক রাশিয়ার প্রতি ইউরোপের প্রত্যাখ্যান ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়তা আটলান্টিকের দুই প্রান্তকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
পুতিন ধরে নিয়েছিলেন, আফগানিস্তান ও ইরাকে ভুল, অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং চীনের উত্থানের কারণে আচ্ছন্ন থাকায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পুরোপুরি পতনের দিকে রয়েছে। যার কারণে ইউক্রেন সংকটে ওয়াশিংটন তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। এখানেও তিনি ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় রাশিয়ার অনুপ্রবেশ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর নির্বাচনগুলোতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ঘটনায় সেসময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো ইউক্রেন ইস্যুতে ভীরু প্রতিক্রিয়া দেখাননি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানকে মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিকে একত্রিত করার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছেন।
এসব ভুল মূলত পুতিনের অহমিকা এবং নিজের মতকেই অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতম মনে করার ফল। ব্যক্তিগত ও জাতিগত গরিমায় পরিচালিত হয়ে তিনি ক্ষয়িষ্ণু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ চালানোকেই সমর্থন করছেন। একজন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হিসেবে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি তিনি সামান্যই গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং অন্তর্গত বিশ্বাস ও গোঁড়া মতবাদেই তিনি নিজেকে পরিচালিত করছেন।
পশ্চিমাদের থেকে আলাদা হয়ে পড়া পুতিনের ইউক্রেনে হামলা চালানোর কোনো বিকল্প ছিল না। বিষয়টি এমন নয় যে, ঘটনাক্রমে তিনি সেটি করেছেন। বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই যুদ্ধকে তিনি বেছে নিয়েছেন। তিনি একজন ইউক্রেনীয় নেতার (ভলোদিমির জেলেনস্কি) সাথে কূটনীতি চালানোকে নিরর্থক কাজ বলে বিবেচনা করেছিলেন। পুতিনের মতে, জেলেনস্কি ওয়াশিংটনের আদেশ অনুসরণ করছিলেন। সুতরাং ইউক্রেনের প্রতি কোনো ধরনের সদ্ভাব না দেখিয়ে তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে, যেসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে পুতিন অভিযোগ এনেছেন, সেগুলোই তিনি করছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবকে ক্ষুণ্ন করেছেন।
তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির ভণ্ডামির কথাও বলতে হয়। স্নায়ুযুদ্ধের প্রেতাত্মা পুতিন হয়তো উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে কোনোভাবেই নিষ্পাপ বলা যাবে না। প্রতিবেশীদের ওপর পুতিনের হস্তক্ষেপ বন্ধে তারা সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্নির্মাণের নামে সেখানে কয়েক দশক ধরে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য বাইডেন সরকার রাশিয়ার নিন্দা জানিয়ে আসছে। কিন্তু তারাই একই ঘটনা ঘটিয়ে ইরাকে বিপর্যয় তৈরি করেছিল। কোনো দোষ না করেও ইরাকি জনগণকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। একজন মার্কিন সিনেটর হয়ে বাইডেন কখনো এই চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের জন্য ক্ষমা চাননি। একইভাবে ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ আরও আরও দেশের অসংখ্য নাগরিক ইউক্রেনীয়দের মতোই ভুক্তভোগী। তারাও অগণিত যুদ্ধ ও দখলদারির শিকার। কিন্তু তাদের তিনি উপেক্ষা করেছেন।
সবশেষে বলা যায়, অহংকার ও ভণ্ডামির মধ্যে পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রবণতা রয়েছে। যার ফলস্বরূপ আরও বড় আঘাত আসে এবং সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটায়। যুদ্ধের ন্যায্যতা তৈরি করার জন্য রুশ ও মার্কিনিরা একই অজুহাত দিয়ে থাকে, যেন তারা যা বলেই সেগুলোই সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে সকল সাম্রাজ্যবাদীর পরিণতি আমরা জানি। এরপরেও বিশ্বশক্তিগুলো কেন এমন বড় ভুল করে? এর মাধ্যমে কি তারা ভিন্ন ফলাফল আশা করে? তাহলে অহংকার কি তাদের উন্মাদ করে ফেলে?
বুদ্ধিমানরা শুধু নিজের ভুল থেকে শেখে না, অন্যের ভুল থেকেও শেখে। শুধু বোকারাই সেটি করে না। তারা নিজ থেকেও শেখে না, অন্যের কাছ থেকেও না। যেমনটি আমরা আজ ইউক্রেনে দেখতে পাচ্ছি।
আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: রাফসান গালিব
মারওয়ান বিশারা আলজাজিরার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক