মতামত

যুক্তরাষ্ট্র নীতি বদলে ফেলছে, স্বীকৃতি পাবে তালেবান সরকার?

সম্প্রতি কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়
ছবি: আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

২০২১ সালের বসন্তকালে তালেবানরা যে নাটকীয় ও তড়িত আক্রমণ শুরু করেছিল, তার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তালেবানের প্রত্যাবর্তন ও পশ্চিমাদের বিশৃঙ্খল পশ্চাৎপসারণের ঘটনাপ্রবাহ আফগানিস্তানের ওপর দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার দুঃখজনক শেষ পরিণতি।  আফগানিস্তান এমন একটি দেশ, যারা আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং সেখান থেকেই তিনি ৯/১১–এর সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন।

আফগানিস্তানের জন্য তালেবানের ফিরে আসার মানে হচ্ছে, একটা চরম অনুদার শাসনব্যবস্থার শুরু, যারা নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ভীষণ রকম বৈরী।

তালেবান এত দ্রুত শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেছিল যে তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। আফগান সরকার খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু আর যেসব ঘটনা গত দুই বছরে ঘটেছে, তার বেশির ভাগই আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল। যেমন মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়া থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সংকট—এসব আগেই ধারণা করা গিয়েছিল।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার এ বছরের জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৫০ লাখ আফগান অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছেন, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ৩০ লাখ। আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতি নজিরবিহীনভাবে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১ কোটি ৮০ লাখ অর্থাৎ আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন।

তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানে সহিংসতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যায়।  এরপরও গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের সূচক অনুযায়ী, আফগানিস্তান বিশ্বের কম শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে।

এর কারণ হলো তালেবান ও ইসলামিক স্টেট খোরসান (আইএস-কে) মধ্যকার চলমান বৈরিতা। ইসলামিক স্টেটের এই শাখাটি এখন তালেবানের জন্য নিজের দেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ধারণা করা হয়, আইএস-কে ৪০০০-৬০০০ যোদ্ধা দিয়ে গঠিত। আগের আমলের সেনা কর্মকর্তা ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নেতারা যাঁরা তালেবান শাসনের বিরোধী, তাঁরা যুক্ত হয়েছেন আইএস-কে সংগঠনে।

আফগানিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়ার পেছনে প্রধানভাবে দায়ী আইএস-কে। আফগানিস্তানের উত্তর এবং উত্তর–পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে তারা শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে।

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে, আইএস-কে আফগানিস্তানের উত্তর দিকের প্রতিবেশী মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একই রকম হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া এ বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আত্মঘাতী বোমা হামলার পেছনে আইএস-কে দায়ী বলে দাবি করা হয়। ওই হামলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।

যাহোক, আইএস-কে পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি নয়। বরং, তালেবানের দীর্ঘদিনের মিত্র তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন পাকিস্তানের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির নিরাপদ স্বর্গ এখন আফগানিস্তান। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দলছুটদের একত্র করে টিটিপি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

তালেবান ক্ষমতায় আসায় পর, আঞ্চলিক আরও কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরও অবাধে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার পরিবেশ পাচ্ছে। এর মধ্যে ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান ও তুর্কেস্তান ইসলামিক পার্টি রয়েছে। এ ছাড়া আরও অংসখ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে। এসব গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা ১০ জন থেকে শুরু করে কয়েক শ জন পর্যন্ত। কিন্তু তারা একে অপরকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আর আইএস-কের মতো তাদের সংখ্যাও বাড়ছে।

এটা নির্দিষ্টভাবে চীনের জন্য উদ্বেগের কারণ। বেইজিং এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে উইঘুর চরমপন্থীদের সংগঠন তুর্কেস্থান ইসলামিক পার্টি ভবিষ্যতে চীন ও পুরো অঞ্চলে চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বার্থে হামলার জন্য আফগানিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

পানির যুদ্ধ

সন্ত্রাসবাদের বাইরে অতিমূল্যবান পানিসম্পদ এখন সেখানে সংঘাতের বড় উৎস। তালেবান এখন কস-টেপা সেচ খাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। আমু দরিয়া নদীকে কেন্দ্র করে এই সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হলে উজবেকিস্তান ও তুর্কেমিস্তানে পানিপ্রবাহ ১৫ শতাংশ কমে যাবে। এতে দুটি দেশেই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব পড়বে।

ইরানের সঙ্গে তালেবানের পানিকেন্দ্রিক আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তেহরান পানি না দেওয়ায় তালেবানরা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীসহ সেনাদের প্রস্তুত করছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

ঘরে-বাইরে ভীতি ও হুমকি

তালেবান শাসনের দুই বছর পর আফগানিস্তানে ভিন্ন ধরনের হলেও সমস্যার অন্ত নেই। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই বছরের আলোচনা প্রচেষ্টার পর ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। চুক্তির পর পশ্চিমা সেনারা আফগানিস্তান থেকে সরে গেলেও আফগান সমাজের পুনরেকত্রীকরণ হয়নি।

এর বিপরীতে ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তালেবানকে সেখানে ভয় ও হুমকির পরিবেশের মধ্যে শাসন পরিচালনা করতে হচ্ছে। আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ স্বর্গে পরিণত হতে দেবে না বলে যে অঙ্গীকার তারা করেছিল, তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে তালেবান।

যাহোক, এর ফলে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি। সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলো আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা ও নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের চিন্তা করছে।

আগস্ট মাসের শুরুতে কাজাখস্তানে আফগানিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তানে খাদ্যশস্য ও গম রপ্তানির জন্য দুই দেশের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়।

আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ খনিজের মজুত আছে। এর মধ্যে ক্রিটিকেল বিরল খনিজও রয়েছে। সে কারণে আফগানিস্তানের লিথিয়াম খনিতে চীন বিনিয়োগ করেছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের আমু দরিয়া নদীর বেসিনে তেলকূপ খননের জন্য চীনের কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

যদিও এসব প্রচেষ্টার মানে এই নয় যে তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা থেকে এটি বলা যায় যে ধীরে হলেও তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া অবধারিত। আর ওয়াশিংটনের তরফ থেকে যখন তালেবানের সঙ্গে কাজ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন সেটি আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কাতারের দোহায় সম্প্রতি দুই পক্ষের উচ্চপর্যায়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানের জনগণের প্রতি তালেবানের আচরণ ও ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ওয়াশিংটন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে তাদের এই সংলাপ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের নীতির দৃশ্যমান বদল।

কাবুলে নতুন পর্যায়ে তালেবান শাসন দুই বছর পূর্ণ করল। তালেবান শাসকেরা এই দুই বছরে তাঁদের নিপীড়ন জনগণের ওপর আরও শক্ত করে চাপিয়ে দিয়েছে। কাছের ও দূরের প্রতিবেশী দেশগুলোর পুরোনো ও নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনে তারা তেমন কিছুই করেনি। সুতরাং তালেবান সরকারের সঙ্গে আবার কাজ করার এই আপাত–ইচ্ছা প্রকাশ করা তাদেরকে ভুল বার্তা দেবে। এতে আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আসবে সেটা ভাবা ঠিক হবে না।

  • স্টিফেন উলফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত