খবর শুনেই এক ধাপে ইলিশের দাম কেজিতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
খবর শুনেই এক ধাপে ইলিশের দাম কেজিতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

এই ইলিশ কারা কিনছে

ইলিশ নিয়ে সরগরম ফেসবুকপাড়া। ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি, পাল্টাযুক্তি চলছে। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে কখনো পপুলিস্ট রাজনীতির, আবার কখনো কূটনীতির সফট হাতিয়ার হতে দেখলাম। কিন্তু ভরা মৌসুমেও বাংলাদেশে ইলিশের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ১ কেজি সাইজের একটা ইলিশের দাম ঢাকার বাজারে ১ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। জাটকার চেয়ে একটু বড় সাইজের ইলিশের দাম ৭০০–৮০০ টাকার নিচে নয়।  

অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা প্রথমে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের পাতে না দিয়ে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হবে না। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুরোধে এবারে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয়।

এ খবর শুনেই এক ধাপে ইলিশের দাম কেজিতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অথচ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। ফলে ভারতে রপ্তানির অনুমোদন দেওয়ায় ইলিশের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিই ধোপে টেকে না।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে হাসিনার আমলের স্বৈরতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে অর্থনীতিতে যে অলিগার্কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার সুবিধাভোগী ছিল সমাজের ওপরতলার কয়েক শতাংশ মানুষ। সীমাহীন দুর্নীতি আর অবাধ লুটপাটের এই রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ট্রিকল ডাউন বা চুইয়ে পড়া পদ্ধতিতে আরও কয়েক শতাংশ মানুষ সুফলভোগী হলেও সমাজের বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে সমাজে বৈষম্য এতটাই বেড়েছে যে বাংলাদেশ চরম বৈষম্যের একটা দেশের দিকে পা বাড়ানোর একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। 

ইলিশের দাম এমন অস্বাভাবিক হওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের যুক্তি, এবারে ইলিশ মাছ মিলছে না। সমকাল–এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ঢাকার পাইকারি বাজারে ইলিশের সরবরাহে এবার তেমন কোনো ঘাটতি নেই। তাহলে ইলিশের দাম এবার এমন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল কেন? উত্তরটা সিন্ডিকেট। সাগরে ইলিশ ধরতে যাওয়ার আগে থেকেই শুরু হয় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে জেলেরা না পায় ইলিশের দাম, আবার ক্রেতাদের কিনতে হয় অনেক বেশি দামে।

মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে জেলেদের সাগরে ইলিশ ধরতে যেতে হয়। এই দাদনদাতাদের মাধ্যমেই জেলেদের মাছ বিক্রির বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে কমিশন এজেন্ট হিসেবে তাঁরা ১০ শতাংশ অর্থ পান। এরপর তিন থেকে পাঁচবার হাতবদল হয়ে ইলিশ ক্রেতার হাতে পৌঁছায়। ফলে এক কেজি সাইজের যে ইলিশ উৎসে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, সেই ইলিশই ক্রেতাকে কিনতে হয় ১ হাজার ৯০০ টাকায়। আগের সরকারগুলোর অংশ হয়ে উঠেছিল বাজার–সিন্ডিকেট। বর্তমান সরকার এখনো সিন্ডিকেট ভাঙার দৃশ্যমান কোনো  উদ্যোগ নিতে পারেনি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্প তৈরি পোশাকশিল্প। প্রায় ৫০ বছর বয়সী এ শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো চা–খাতের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। জিডিপিতে অবদান কমে যাওয়া কৃষি ছোট্ট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের খাবারের বেশির ভাগ জোগান দিলেও তাঁরা দিন আনি দিন খাইয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। সরকারি চাকরিজীবীদের কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে বৈধ আয় করে সংসার চালাতে হয়—এমন কারও পক্ষেই ইলিশ কেনা সম্ভব নয়। তাহলে এত দামি ইলিশ কারা কিনছে? এই যে ইলিশের বাজার চড়তে চড়তে এমন সপ্ত আসমানে গিয়ে ঠেকেছে যে বাজার থেকে কারা ইলিশ কিনছে, সেটা এখন শতকোটি টাকার প্রশ্ন।

রাষ্ট্র বলি আর রাজনৈতিক অর্থনীতি বলি, সেখানে যে জঞ্জাল জমা হয়েছে, সেটাকে শুধু শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের জঞ্জাল বলাটা আধা সত্য হবে। সত্যটা হলো, এটা ৫৩ বছরের জঞ্জাল। আর সেই জঞ্জালের মূল কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশদের ১৯০ ও পাকিস্তানের ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর। বাংলাদেশের সমাজ যে গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন হয়ে উঠতে পারেনি তার বড় কারণ, এখানে সরকার ও নাগরিকের সম্পর্ক এখন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ধরনের শাসক ও শোষিতের আর প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক।

এই ক্ষমতাকাঠামোয় সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি এলিটদের বা নব্য জমিদারদের তৈরি করে, যাঁরা রাষ্ট্র ও সরকারের সব ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। সেই অর্থ অনায়াসে পাচার করে দিয়ে তাঁরা পৌত্র–পুত্রাদিক্রমে প্রথম বিশ্বের নাগরিক বনে যান। 

রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে হাসিনার আমলের স্বৈরতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে অর্থনীতিতে যে অলিগার্কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার সুবিধাভোগী ছিল সমাজের ওপরতলার কয়েক শতাংশ মানুষ। সীমাহীন দুর্নীতি আর অবাধ লুটপাটের এই রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ট্রিকল ডাউন বা চুইয়ে পড়া পদ্ধতিতে আরও কয়েক শতাংশ মানুষ সুফলভোগী হলেও সমাজের বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে সমাজে বৈষম্য এতটাই বেড়েছে যে বাংলাদেশ চরম বৈষম্যের একটা দেশের দিকে পা বাড়ানোর একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। 

শেখ হাসিনার আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অলিগার্করা কত সম্পদের মালিক হয়েছিলেন, তার একটা নজির সম্প্রতি আল-জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তাঁর সম্পদ রয়েছে।

আল–জাজিরার কাছে তিনি অবলীলায় তাঁর বিলাসী জীবনের গল্প বলে গেছেন। নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হেরডসেও কাস্টম মেড জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে। এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম তিন হাজার পাউন্ড।’

শুধু সাইফুজ্জামান চৌধুরী নন, এ তালিকায় শেখ হাসিনা সরকারের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সামরিক-পুলিশ-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের শত শত নাম যুক্ত হবে। বাংলাদেশের সমাজের ওপরের তলার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আর সমাজের অন্য তলাগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্যের মধ্যে ব্যবধানটা এখন আসমান-জমিনের। কয়েক শতাংশের মধ্যে কেনার সামর্থ্যটা এতটাই বেড়ে গেছে যে তাঁরা বাজারকে বেসামাল করে ফেলছেন। ফলে ইলিশ এখন বাংলাদেশের অতি বিলাসী মাছ।  একইভাবে যদি আমরা প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস গরু কিংবা খাসির মাংসের কথা চিন্তা করি, সেটাও এখন কয়েক শতাংশ মানুষের খাদ্যপণ্য।

মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী