শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রোপাগান্ডা আর তার দ্বারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিক্রিয়ার ফলে যত দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও খারাপ হচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় হলে, সাধারণত ক্ষতি হওয়ার কথা ছোট দেশের; কিন্তু ভারত যেভাবে একমুখী বাংলাদেশ থেকে সুবিধা নিয়ে গেছে, ক্ষতি হবে ভারতেরই। আর এই সুযোগ যদি বাংলাদেশ নিতে পারে, দেশ স্বনির্ভরতার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে।
প্রথমে দেখি বাণিজ্য। ভারতের সঙ্গে ৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য–ঘাটতি রয়েছে। বণিক বার্তার ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমেছে আরও ৬ শতাংশ। এখন যদি বন্দর বন্ধ করে দেয়, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিতে পারেন। আগে পেঁয়াজ, আলু ও চালের দাম বাড়ত। এখন দেশে পেঁয়াজ যথেষ্ট আমদানি হয়। এ ছাড়া বিকল্পভাবে পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ আসা আমাদের বিকল্প বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বিকল্প এত দিন না থাকায় আমাদের ভারতের ‘গিনিপিগ’ হয়ে থাকতে হতো। পাকিস্তানের পাশাপাশি আমরা যদি মিয়ানমারের সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারি, আরও সস্তায় খাদ্য পাওয়া সম্ভব।
ভারতে রেমিট্যান্স যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থতম। কত জন বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন তার তথ্য পাওয়া না গেলেও ডয়েচে ভেলের একটি প্রতিবেদন থেকে এ দেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় আছেন বলে ধারণা করা যায়। যাঁরা বেশির ভাগই ট্যুরিস্ট ভিসাতে কাজ করেন। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বিদেশিদের কাজ করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া গেলে দেশের বিপুলসংখ্যক বেকারদের চাকরি দেওয়া সম্ভব।
ভারতের অভিন্ন ৫৪ নদীর ৫৩টিতেই বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদী গবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০-এ দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর গড়ে খরায় ক্ষতি ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা এবং বন্যায় গড়ে প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সরকার এখনো ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। এ ঘটনা তাদের ওপর চাপ আরও বাড়াবে, যাতে আমরা ন্যায্য হিস্যা পাই।
চিকিৎসার জন্য বছরে ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেডিকেল ট্যুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন। বিদেশে চিকিৎসা নিতে বছরে দেশের ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যাচ্ছে। এই টাকা দিয়ে পুরা স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তন সম্ভব। এ ছাড়া বাইরের দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষ অন্য দেশ বেছে নেবে এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিকল্প দেশের খোঁজখবরও নেয়া শুরু হয়ে গেছে।
ভারতের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সার্ক পুনরুদ্ধার করতে হবে। আসিয়ানে যোগে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু থাকলেও আমাদের বাণিজ্য চালু করতে হবে। ভারত এ রকম সমস্যা শুধু বাংলাদেশের সঙ্গেই করেনি, ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন হয়েছে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা—এমনকি কাতারেও। সব আশিয়ান দেশেও কোনো না কোনো সময়ে তাদের সঙ্গে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছিল। আর সবাই তাদের ন্যায্য পাওনা উদ্ধার করেই ছেড়েছে।
অধিকারের মতে, ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২৩৬ জন খুন হয়েছেন বিএসএফের হাতে। আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৪৫ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছেন ৭০ জন। এই ডিসেম্বরের ৬ তারিখেও তারা পঞ্চগড়ে একজনকে খুন করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম সংবিধির অনুচ্ছেদ ৭, জাতিসংঘের মৌলিক নীতি, ১৯৯০ নীতি ৯, জেনেভা কনভেনশন ৪, অনুচ্ছেদ ৩ অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আমাদের এ ব্যাপারে আইসিসিতে বিচার চাওয়া উচিত।
ভারতে যত পর্যটক যান, তার মধ্যে সব থেকে বেশি যান বাংলাদেশ থেকে, যা মোট পর্যটকের ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই খাত থেকে ভারতের আয় ১৭ বিলিয়নের মতো। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমরা তাদের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ অবদান রাখছি!
পশ্চিমবঙ্গে রাজধানী কলকাতার মারকুইস স্ক্রিটকে বলা হয়ে থাকে মিনি বাংলাদেশ। ওই এলাকার রাস্তা ও অলিগলি বাংলাদেশি টুরিস্ট, ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের ভিড় লেগেই থাকে। এখন সেসব রাস্তা ও অলিগলি ফাঁকা পড়ে আছে। কলকাতার নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি ক্রেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এখন বাংলাদেশি ক্রেতাও নেই, তাদের ব্যবসাও নেই।
শুধু দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা নয়, সেখানকার হোটেলমালিক, হকার, খাবারের দোকানদার, ক্যাবচালক সবার আয়–উপার্জনে লালবাতি জ্বলছে। বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করে দিয়ে উল্টো ভারতীয় নাগরিকদেরই বিপদে ফেলে দিয়েছে ভারত। এসব খবরাখবর ভারতের মিডিয়া থেকেই আমরা পাচ্ছি। তা থেকে আমরা জানছি, বাংলাদেশি ক্রেতার অভাবে কয়দিন পর ‘না খেয়ে মরতে হবে’ কলকাতার ব্যবসায়ীসহ সেখানকার বিভিন্ন পেশার মানুষকে।
এখন আসি এ দেশের সঙ্গে যেসব অন্যায় চুক্তি হয়েছে সেখানে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তিনটি লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তি হয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে মোট ৭৩৬ কোটি ডলারের ঋণ দেবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ ছাড় হয়েছে মাত্র ১৮৪ কোটি ডলার। যে কাজ আবার করাতে হবে ভারতীয় কোম্পানি দিয়েই। আর তারা সেসব প্রজেক্টেই টাকা দিচ্ছে, যা দিয়ে তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে ট্রানজিট বা বিদ্যুৎ নিয়ে যেতে পারে। আসল সুবিধাভোগী ছিল তারাই। ভারত ট্রানজিট নিচ্ছে নামমাত্র মূল্যে; সেটা সড়ক, নৌপথ বা চট্টগ্রাম এবং মোংলা পোর্ট ব্যবহার করে। এই সব দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে।
এ ছাড়া যে আদানির সঙ্গে চুক্তি, রামপাল এগুলোও আমলে নেওয়ার সময় হয়েছে। আদানির সঙ্গে যে চুক্তি করেছে পতিত আওয়ামী সরকার, সেখানে কোনো ‘এক্সিট ক্লজ’ নেই। এ ছাড়া অপ্রকাশিত আরও চুক্তি আছে বলে মানুষের বিশ্বাস এবং এই সব চুক্তি প্রকাশ্যে আনার জন্য মানুষ চাপ প্রয়োগ করছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সেই উক্তি, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি, সারা জীবন মনে রাখতে হবে।’ এসব চুক্তি যেসব দেশবিরোধীর মাধ্যমে হয়েছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। শুধু রাজনীতিবিদেরা নন, সরকারি আমলারাও সমানভাবে দায়ী।
ভারতের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সার্ক পুনরুদ্ধার করতে হবে। আসিয়ানে যোগে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু থাকলেও আমাদের বাণিজ্য চালু করতে হবে। ভারত এ রকম সমস্যা শুধু বাংলাদেশের সঙ্গেই করেনি, ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন হয়েছে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা—এমনকি কাতারেও। সব আশিয়ান দেশেও কোনো না কোনো সময়ে তাদের সঙ্গে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছিল। আর সবাই তাদের ন্যায্য পাওনা উদ্ধার করেই ছেড়েছে।
আমাদের সমস্যা ছিল আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, যা ভারতকে সব ছেড়ে দিয়ে, এখন যখন আমরা সমমর্যাদা চাচ্ছি, সেটা আর তাদের সহ্য হচ্ছে না। আর এই অবস্থা আসলে আমাদের নিজেদের স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ। আমাদের ব্যবসায়ী বা সরকার কি এই সুযোগ নিতে পারবে?
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: contact@subail.com