গেল বছরের শেষ ভাগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈঠক করেছিলেন। তাঁদের বৈঠককে কেউ কেউ তখন চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় গাঁটছড়া বাঁধার অন্যতম ধাপ বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
কিন্তু সি–বাইডেনের বৈঠককে বড়জোর দুই দেশের ছোটখাটো মানভঞ্জনের সূচনা বলা যেতে পারে। কারণ, এই বৈঠক দুই দেশের বিদেশনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি।
১৯৭২ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা হয়েছিল রিচার্ড নিক্সনের হাত ধরে। বিল ক্লিনটন সেই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়েছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সমালোচকেরা তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের চীন–নীতিকে অদূরদর্শী বলে বর্ণনা করে এসেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ছোঁয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের কনফুসিয়াস ভাবধারার সমাজ যেভাবে রক্ষণশীল পথ থেকে উদার পথে উঠে এসেছে, একইভাবে চীনের কনফুসিয়াস ভাবধারার সমাজও উদার হয়ে উঠবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সি চিন পিং চীনকে আগের চেয়ে আরও রক্ষণশীল ও কর্তৃত্ববাদী করে তুললেন।
তবে আমেরিকার বিদেশনীতি সব সময়ই বাস্তবসম্মত মাত্রা ধরে রেখেছে। সোভিয়েত হুমকি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। আর শীতলযুদ্ধ–পরবর্তী যুগে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান প্রতিরক্ষা চুক্তি যাতে অটুট থাকে, তা নিশ্চিতকরণে ক্লিনটন চীনের সঙ্গে সেই সম্পর্ককে দৃঢ় করেছিলেন।
যাঁরা ক্লিনটনকে অদূরদর্শী বলে থাকেন, তাঁরা সাধারণত এই বিষয়টি এড়িয়ে যান যে ক্লিনটনের চীন-নীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র-জাপান জোট আজও এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি শক্তিশালী ও মৌলিক উপাদান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
এ কথা ঠিক, চীনের উদ্দেশ্য ও সক্ষমতার বিচারে ক্লিনটনের খানিকটা ঘাটতি ছিল। যেমন চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার বিষয়টি তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে চীনের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’খ্যাত নজরদারি ব্যবস্থা বেশ ভালো কাজ করেছে।
এখন সবাই এ বিষয়ে একমত যে চীনের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্যপদ লাভের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিকা ছিল এবং সেই বিবেচনায় ডব্লিউটিওর নিয়মকানুন না মানায় চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।
তবে এটিও ঠিক, চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিতে গণতন্ত্র না আনলেও কিছুটা উদারতা এনেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিয়েছেন, চীনা নাগরিকেরা চীনের ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এবং হোয়াইট হাউসের এশিয়াবিষয়ক সমন্বয়ক কার্ট ক্যাম্পবেল সরকারি দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগে বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গড়ে উঠলে সেটি চীনের রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনবে বলে যে ধারণা করা হয়েছিল, সেই ধারণায় গলদ ছিল। তাঁদের এ কথাও ঠিক, চীনে মৌলিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে জোর খাটানোয় যুক্তরাষ্ট্র অক্ষম। কিন্তু তার মানে এই নয়, চীনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ এবং ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইস্যুতে চীনা পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য সংশোধন আনা হয়েছে।
এ ছাড়া পর্যবেক্ষকেরা আরও কতকগুলো ভালো দিকের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন চীন এখন ভ্রমণকারীদের আগের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে থাকে; দেশটি বৈদেশিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে; মতপ্রকাশের পরিসর আগের চেয়ে বিস্তৃত করেছে এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাকে কাজ করতে অনুমতি দিচ্ছে।
আমি যখন ক্লিনটন প্রশাসনের অধীনে কাজ করছিলাম, তখন কংগ্রেসকে বলেছিলাম, ‘যদি আমরা চীনকে শত্রুজ্ঞান করি তাহলে ভবিষ্যতে চীনকে আমরা যে শত্রু হিসেবে পাব, তার নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু আমরা যদি চীনকে বন্ধু হিসেবে ভাবি, তাহলে তাকে বন্ধু হিসেবে পাব, তার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। তবে আমরা অন্তত ভালো কোনো ফলাফলের পথ উন্মুক্ত রাখতে পারি।’
২০০১ সালের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল এই বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘চীন আমাদের শত্রু নয় এবং চীনকে শত্রু না ভাবার ধারাটিই আমাদের অনুসরণ করে যেতে হবে।’
পেছনে তাকিয়ে আমি এখনো মনে করি, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হাত মেলানোটা বাস্তবসম্মত ছিল। অবশ্য এটি নিয়েও আমার অনুশোচনা বোধ আছে যে আমরা সি চিন পিংয়ের চীনের কাছ থেকে যে আচরণ পাচ্ছি, তার চেয়ে ভালো কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য অনেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা বোঝেন না, ট্রাম্প হচ্ছেন সেই অবুঝ বালকের মতো, যে কিনা চীনের ধরিয়ে দেওয়া আগুনে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে।
সি চিন পিং ২০১২ সালের শেষের দিকে ক্ষমতায় আসেন এবং এসেই রাজনৈতিক উদারীকরণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দেওয়া বাড়িয়েছেন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণকে অধিকতর কঠোর করেছেন।
সি মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছেন, তিনি ‘পরাশক্তিগুলোর সম্পর্কের জন্য একটি নতুন মডেল’ দাঁড় করাতে চান যেটি সমান অংশীদারির ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মির শীর্ষ কমান্ডারদের সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, তিনি ভালো করে জানেন, পশ্চিমারা কখনোই চীনের উত্থান মেনে নেবে না।
যদিও ট্রাম্প এবং সি দুজনই চীন-আমেরিকার বিচ্ছেদে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, তবে এই দুই শক্তির বিচ্ছেদের মূল শিকড় আরও গভীরে।
১৯৭০–এর দশকের শেষ দিক থেকে চীনের নেতা দেং জিয়াওপিং চীনকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে বাজারব্যবস্থায় সংস্কার এনেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ‘শক্তি লুকিয়ে রেখে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকার’ নীতি অনুসরণ করে মধ্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতির পথে হেঁটেছিলেন।
তবে হু জিন তাওয়ের আমলে চীনের অভিজাত গোষ্ঠী ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দাকে আমেরিকান অর্থনীতির ধস হিসেবে দেখেছিলেন। তখন তাঁরা দেং জিয়াও পিংয়ের পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসা শুরু করেন। তাঁরা আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি গ্রহণ করা শুরু করেন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বেসামাল করে ফেলে।
চীন পরাশক্তির মতো আচরণ শুরু করে। চীনের আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। জনতুষ্টিবাদী আমেরিকানদের ভোট পেতে ২০১৬ সালে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছিলেন।
তখন থেকেই মূল উত্তেজনার শুরু। সেই উত্তেজনা চলছে। আবার দুই দেশের সম্পর্ক আগের জায়গায় যাবে, এমনটা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
জোসেফ এস নাই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ