মতামত

দাম বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়

দেশে এখন দাম বাড়ানোর হিড়িক চলছে। আগে কেবল সুযোগ বুঝে চাল, তেল, পেঁয়াজ, নুনের মতো ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হতো। এখন সরকার ও তার সংস্থাগুলো এ প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশের বেশি বাড়ানোর হয়েছে। এর ধকল না কাটতেই খবর এসেছে পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা। চলতি মাসেই বাড়ানো হতে পারে বিদ্যুতের দাম। গণশুনানিকালে বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

ইতিমধ্যেই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সংরক্ষিত কবরের ওপর আবার কবর দেওয়ার জন্য ফি বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংরক্ষিত কবরের ওপর কবর দেওয়ার জন্য ফি ২০ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বনানী কবরস্থানে ৫০ হাজার টাকা এবং অন্য কবরস্থানে ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

মনে হচ্ছে, দেশজুড়ে সরকারি সংস্থাগুলো তাদের পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির এক নির্মম ও অশোভন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। কারণ হিসাবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, টাকার বৈদেশিক বিনিময়ে মূল্যহ্রাস, এমনকি আইএমএফের ঋণের শর্তের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পণ্য ও সেবার দাম বাড়ানোই কি একমাত্র পথ? দাম বাড়ানো সহজ হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা সবারই জানা আছে।

সাধারণভাবে সরকারি পণ্য ও সেবার দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি দুটি। একটি সামষ্টিক (ম্যাক্রো), অন্যটি ব্যষ্টিক (মাইক্রো)। সামষ্টিক যুক্তিটি হলো সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনা। অন্য কথায় বলা যায়, বাজেটঘাটতি সীমিত রাখা। ব্যষ্টিক যুক্তিটি হলো সরকারি পণ্য ও সেবার খরচ পুনরুদ্ধার (কস্ট রিকভারি)।

কর রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা

বর্তমান সরকারি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির আসল কারণ হলো ‘কাপড়ের পরিমাপ না ভেবে পোশাক বানানো’। বাংলাদেশের কর জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-২০ সালে বাংলাদেশের গড় কর রাজস্বের অনুপাত ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ; একই সময়ে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এ অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৬৭, ২১ দশমিক ৫, ১৪ দশমিক ৮৮ ও ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

কর রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে—ক. সীমিত আয়কর জাল, শুল্ক ও করাদি থেকে বিপুলসংখ্যক পণ্যের অব্যাহতি; খ. ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ, ফলে সঠিক করনীতি প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না; গ. ব্যাপক চাঁদাবাজি; ঘ. অসৎ রাজস্ব কর্মকর্তা, আয়কর উপদেষ্টা, ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট সমন্বয়ে ঘটিত সিন্ডিকেট, যারা সৎ করদাতাদের হয়রানি করে কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করে ও অসৎ ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করে থাকে।

কর রাজস্ব আদায় আশানুরূপ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার দেশি-বিদেশি ঋণসহায়তা নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চ সুদের বিদেশি ঋণ। শুধু তা-ই নয়, হাত দিয়েছে বিপিসি ও অন্যান্য করপোরেশনের মেয়াদি আমানতে। তাই সিপিডি উল্লিখিত ২০১৫-২১ সালের বিপিসির মুনাফা ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকার অবস্থা হয়েছে ‘কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই’। এভাবে আপৎকালে ব্যবহারের সরকারের সম্পদ ধ্বংস করে অর্থনীতিকে বিপন্ন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত প্রভুদের পারিবারিক তৈজসপত্র (ফ্যামিলি সিলভার) বিক্রির কথা মনে করিয়ে দেয়।

পাশাপাশি সরকারি আবর্তক ও উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয়ের চূড়ান্ত করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বানরের পিঠা ভাগের মতো জনগণের অর্থ সরকারঘনিষ্ঠ লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। তাই এখন সরকার পরিচালনার অর্থ সরকারের নেই। সে দায় মেটানোর জন্য সরকারি পণ্য ও সেবার মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারি পণ্য ও সেবার এসব মূল্যবৃদ্ধি অন্য সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে এখন সাধারণ মূল্যস্ফীতির পালে জোর বাতাস দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে এবং অতি মূল্যস্ফীতি অনিবার্য হয়ে উঠবে।

সরকারি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে। প্রয়োজন বোধে ভর্তুকি দিতে হবে। এ জন্য আগেভাগেই তহবিল গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে অনুসৃত সরকারি পণ্য ও সেবার মূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি করার হঠকারী, অমানবিক ও অর্থনীতিবিধ্বংসী নীতি পরিহার করতে হবে।

সরকার কী করতে পারত

প্রথমেই কর রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। এ খাতে মাফিয়া চক্রকে প্রতিরোধ এবং বণিক প্রভাব ও দুর্নীতি সীমিত করতে হবে। এটা সহজ বা দুরূহ কোনোটাই নয়। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সম্মেলনকক্ষে আয়কর ও শুল্ক ও আবগারি কমিশনারদের একটা সভায় আইএমএফের শর্ত প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমার পাশে বসে ছিলেন সদস্য (আয়কর) ইফতেখার আহমদ।

তিনি পরিহাস করে বললেন, কবির, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপরি আয়ের ওপর কর পেলেই তো কর জিডিপির অনুপাত ১ থেকে ২ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব! আর এই রুমে আমাদের সহকর্মীরা তাদের ‘প্রকৃত টেক হোমের’ ওপর কর দিলেই তো আইএমএফের শর্ত পূরণ হয়ে যাবে। পরিহাসের ছলে কথাগুলো বললেও করব্যবস্থায় বিদ্যমান ব্যাপক দুর্নীতি রোধ না করে কর রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়।

পাশাপাশি সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বলা হচ্ছে এগুলো কৃচ্ছ্রসাধন। আসলে এগুলো মোটেই কৃচ্ছ্রসাধন নয়, বরং অপব্যয় রোধ। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাঁটাই ও সরকারি প্রকল্প অনুমোদন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এলেই প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থের সংস্থান করা সম্ভব।

সরকারি পণ্য ও সেবার খরচ পুনরুদ্ধার

কস্ট রিকভারির ক্ষেত্রে ও প্রকৃত খরচ নির্ধারণ করতে হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সংস্থাগুলোর প্রবাদপ্রতিম দুর্নীতি ও অদক্ষতার মূল্য জনগণ কেন দেবে? তাই আগে এসব সংস্থাকে হাঙ্গেরীয় অর্থনীতিবিদ অানোস কর্নাইয়ের ভাষায় কঠিন বাজেট বাধ্যবাধকতার সম্মুখীন করতে হবে। এ ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এসব সংস্থার ব্যয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সাশ্রয় করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে স্থানীয় পণ্যমূল্যের ইনডেক্সিং

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ওঠানামার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় মূল্য স্থিতিশীল বা সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে ইনডেক্সিং করে এসব পণ্যের স্থানীয় মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ভারতসহ অনেক দেশই জ্বালানির মূল্য এ পদ্ধতিতে নির্ধারণ করে। পৃথিবীর সর্বত্র জ্বালানি তেলের মূল্য একটি সীমার মধ্যে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। ফলে এসব দেশের সরকারকে জ্বালানি তেলের মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে স্থানীয় দাম বাড়ে আর কমলে তার সুফলও স্থানীয় ক্রেতারা ভোগ করে। পরিবহন, শিল্প খাত এ পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়।

ভর্তুকির অর্থনীতি

সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বের দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক রাখা, পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য সাময়িক উৎপাদন, ভোক্তা, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এর অর্থসংস্থান করা হয় কর–রাজস্ব, পণ্যমূল্য স্থিতিশীল করার জন্য গঠিত বিশেষ তহবিল ও নিয়োগকর্তার চাঁদা থেকে।

সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মতো সিটি করপোরেশনের অর্থায়নের ক্ষেত্রে সেবার দাম না বাড়িয়ে অর্থ সংগ্রহের নতুন পথ, যেমন পার্কিং ফি, মিউনিসিপ্যাল বন্ড ইত্যাদি যোগ করতে হবে।

শেষ কথা

সরকারি খাতের পণ্য ও মূল্যের সেবার মূল্য স্থির থাকবে, তা বাড়ানো যাবে না, এমন নয়। তবে তা হতে হবে ক্রমান্বয়িক ও যৌক্তিক, যাতে মূল্যস্ফীতি সীমা ছাড়িয়ে ভোক্তা ও শিল্পের দুর্ভোগের কারণ না হয়। পারিবারিক বাজেটের ওপর সরকারি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির ক্রমপুঞ্জিত আপতন হিসাব করতে হবে। পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে স্থানীয় মূল্যের ইনডেক্সিং করতে হবে।

সরকারি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে। প্রয়োজন বোধে ভর্তুকি দিতে হবে। এ জন্য আগেভাগেই তহবিল গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে অনুসৃত সরকারি পণ্য ও সেবার মূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি করার হঠকারী, অমানবিক ও অর্থনীতিবিধ্বংসী নীতি পরিহার করতে হবে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ