শ্রীলঙ্কায় এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে

গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের খবরে মিষ্টি বিলিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তবে সেই মিষ্টি কেউ কেউ মুখে তুলতে চাননি
ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া ছবিগুলো অসাধারণ: বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বিছানায় কুস্তি করছেন, তাঁর সুপ্রশস্ত লনে রান্না করছেন এবং তাঁর সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন।

এ গণক্ষোভের সবটাই মূলত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে লক্ষ্য করে। এর প্রধান কারণ, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা গোতাবায়ার আমলে এসে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে এবং গোতাবায়ার প্রশাসন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নগদ বেল আউটের (আগের ঋণ শোধ না করেই জরুরি প্রয়োজনে নতুন ঋণ নেওয়া) জন্য শ্রীলঙ্কাকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করেছে। গোতাবায়া গত মঙ্গলবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।

গোতাবায়া এখনো সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছেন নাকি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণাত্মক দমন-পীড়ন করছেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশকে দেউলিয়া করে দেওয়া স্থূল আর্থিক দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর এখন জনতা প্রবলভাবে ক্ষিপ্ত।

এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন পার্লামেন্ট স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে। দেশ ছেড়ে পালানো গোতাবায়া রাজাপক্ষে গত বুধবার ই-মেইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। তবে শ্রীলঙ্কায় এরপর কী হবে, সে ধরনের বড় একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে। কে প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। তবে তার আগে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যভিত্তিক একটি চুক্তিতে আসতে হবে। এ ধরনের একটি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হবে একটি সীমিত সময়ের জন্য প্রেসিডেন্টের নিয়োগ। এটি কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্টের পদ বাতিল করার প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করবে এবং পরে সংসদ ভেঙে দেবে। প্রতিটি পদক্ষেপে বিরোধী রাজনীতিকদের আইন ও শ্রীলঙ্কার জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

এ লেখা যখন লিখছি, ঠিক সে সময় দেশটির পার্লামেন্টের ২২৫টির মধ্যে ৫০টি আসন অধিকারী প্রধান বিরোধী দল সামাগি জনা বালাওয়েগয়া (এসজেবি বা ইউনাইটেড পিপলস পাওয়ার) অন্য দলগুলোকে নিয়ে একটি ঐকমত্য চুক্তিতে আসার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল।

চার দশকের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক পতনের একাধিক ক্ষত সারিয়ে শ্রীলঙ্কার ভাঙা অর্থনীতিকে মেরামত করা এবং সুস্থ করা সহজ হবে না।

একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ দেশটিতে শিকড় গাড়লেও সমাজে জাতিগত পরিচয় এবং ধর্মভিত্তিক কিছু চিড় আছে। তবে সেই বিভেদের চিড় ঝাপসা হয়ে গেছে এবং লোকেরা সামাজিক মিডিয়ায় এমনভাবে প্রতিবাদ করার জন্য সংগঠিত হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। শ্রীলঙ্কা এরপর কোথায় যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়, তবে এ মুহূর্তে সেখানে এমন কিছু ঘটেছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।

দেশটিতে দারিদ্র্যের গভীরতা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় যারাই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিক, তাদের অবশ্যই দেশটি যে জ্বলন্ত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে, তার তাৎক্ষণিক সমাধান কার্যকর করতে হবে। যেমন দরিদ্র জনগণের হাতে নগদ অর্থ দিতে হবে। জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে।

ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তাদের সহায়তা সীমিত হবে এবং আইএমএফের বেল আউট পাওয়া যাবে অনেক কণ্টকাকীর্ণ শর্তের জোরে। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা ফিরে পেতে সুশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

নেতারা জবাবদিহি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং ইউরোপে সংঘাত ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যাগুলোর কারণে সৃষ্ট সংকটে তাঁরা আটকে গেছেন।

এ অবস্থা দেশকে একটি অপরিবর্তনীয় নিম্নগামী সর্পিল দিকে নিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এবং তাঁর সহকর্মীরা খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তাঁর নীতিগুলো যে কোনো গণতান্ত্রিক প্রশ্নকে দমন করেছিল। এটি দেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল এবং খাদ্য, জ্বালানি এবং মানবিক সংকটের সূত্রপাত করেছিল।

ইতিবাচক দিক থেকে বলা যায়, শ্রীলঙ্কা এমন একটি জাতির দর্শনীয় বর্ণনা দেয়, যারা গণবিক্ষোভে একত্র হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে এমন একটি পরিবর্তন এনেছে, যা একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া করতে পারেনি। রাজাপক্ষে নির্বাসনে পদত্যাগ করার পর এমন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক রাজবংশের অপমানজনক অবসান ঘটল, যা প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করেছিল।

এ ক্ষমতা ছিনতাই কার্যত একটি রক্তহীন বিপ্লব। এটি অন্যান্য দেশের জন্য একটি পাঠ হতে পারে, যেখানে জনশক্তি এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করতে পারে।

শ্রীলঙ্কা তার অবস্থান, ইতিহাস এবং এর জনগণের অভিজ্ঞতায় বেশ অনন্য। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ দেশটিতে শিকড় গাড়লেও সমাজে জাতিগত পরিচয় এবং ধর্মভিত্তিক কিছু চিড় আছে। তবে সেই বিভেদের চিড় ঝাপসা হয়ে গেছে এবং লোকেরা সামাজিক মিডিয়ায় এমনভাবে প্রতিবাদ করার জন্য সংগঠিত হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। শ্রীলঙ্কা এরপর কোথায় যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়, তবে এ মুহূর্তে সেখানে এমন কিছু ঘটেছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

চারু লতা হগ চাটাম হাউসে এশিয়া প্যাসিফিক প্রোগ্রামের একজন সহযোগী ফেলো