রোহিঙ্গা গণহত্যার সপ্তম বছর পার হলো। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলসহ বৈশ্বিক অন্যান্য সাম্প্রতিক সংঘাতের ডামাডোল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু কি গৌণ হয়ে গেল?
এদিকে বাংলাদেশে বাস করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। শরণার্থী সমস্যার সমাধানে তিনটি সনাতন পদ্ধতি আছে—প্রত্যাবাসন, পুনর্বাসন ও আত্তীকরণ। এ ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই প্রয়োগ করা যায়নি। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু গৌণ হওয়ার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘টাইম বোমা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লিখিত তিন পথের বাইরে এমন কিছু করা যায় কি না, যা টাইম বোমা নিষ্ক্রিয় করতে পারে? সে বিষয়ে কি আমরা যথেষ্ট ভেবেছি?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তদারকিতে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ২০১৭ সালে। কিন্তু ভারতের অসম্মতির কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এটি।
ইতিমধ্যে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূতের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল যেমন একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ, তেমনি বাস্তবসম্মত বিষয় হলো, নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের একক নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে এ–সংক্রান্ত কিছু কাজ অবশ্যই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে, যার মূলে হলো বাংলাদেশের কূটনীতি।
রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল কেবল এই জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত, অনিরাপদ, আশাহীন জীবনের অবসান ঘটাবে। সেই সঙ্গে তা বাংলাদেশের নিজের জন্য এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও সবচেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ হওয়া উচিত
নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মূল সহায়ক শক্তি হলো চীন ও মিয়ানমার। সেই সঙ্গে ভারতেরও মত দেওয়ার বা এই উদ্যোগ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপদ অঞ্চলের ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে স্বীকৃত হতে হবে। বাংলাদেশের অতি দুর্বল কূটনীতি কি পারবে এতগুলো শক্তিকে নিরাপদ অঞ্চলের পক্ষে সম্মত করাতে? কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় এটিই এ মুহূর্তে সবচেয়ে দরকারি কাজ।
এই অঞ্চলের লক্ষ্য হবে রোহিঙ্গাদের জন্য সুরক্ষা ও মানবিক সাহায্য প্রদান। তাই এটি হতে হবে অসামরিক উপায়ে। রোহিঙ্গারা এখানে সহিংসতা ও নিপীড়নের ভয় থেকে মুক্ত থাকবে, এবং তাদের নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। অসামরিক এলাকা হওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘের অধীনে এখানে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার তো বটেই, তাদের কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থা থাকবে। এ রকম একটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো সহজেই অনুমেয়, সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা: ঐতিহাসিকভাবেই মিয়ানমার সরকার তার দেশ থেকে বের করে দেওয়া রোহিঙ্গাদের সে দেশে ঢুকতে না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য বিগত সময়ের কূটনীতির ব্যর্থ কৌশলগুলো এখন বাংলাদেশের বদলাতে হবে।
আঞ্চলিক ভূকৌশলগত জটিলতা: রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ সমর্থন পাবে কি? তার অনেকটা নির্ভর করছে কিছু ভূকৌশলগত জটিলতার ওপর। এগুলো ঠিক পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার বাংলাদেশ মেরুদণ্ড শক্ত করে সেসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ তথা সমঝোতায় ভূমিকা রাখতেও পারে। যেমন শিলিগুড়ি করিডর (চিকেন নেক), উত্তর–পূর্ব ভারতের ৩০টি স্থানের চীনা নামকরণ, তিব্বত ও তাইওয়ানের ভূখণ্ডে চীনের মালিকানা দাবি ইত্যাদি আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশকে এ বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।
নিরাপত্তাজনিত প্রতিবন্ধকতা: নিরাপদ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম, এ রকম একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ, নির্বিঘ্ন পরিবেশ সৃষ্টি, সহযোগিতা অব্যাহত রাখা ইত্যাদি দায়িত্ব কি শরণার্থী হাইকমিশন নেবে, নাকি জাতিসংঘ কর্তৃক নিযুক্ত কোনো বিশেষ দল বা দপ্তর নেবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি।
এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য দূরদর্শী পরিকল্পনা, দক্ষ কূটনীতি ও সব অংশীদারের সঙ্গে যথাযথ সমন্বয় একান্ত আবশ্যক। এটা সবাই জানে যে মিয়ানমারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার প্রায় সবটুকু ক্ষমতা রাখে চীন। চীনের সঙ্গে সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ঘিরে বাংলাদেশ কি সেই ক্ষমতা কাজে লাগাতে চীনকে রাজি করাতে পারে না? আঞ্চলিক ফোরামগুলোকেও অতীতে বাংলাদেশ কখনো কাজে লাগায়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আসিয়ান, ওআইসি, সার্ককে পাশে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের এখন কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্ব দেখেছে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা বিষয়ের প্রস্তাবে যেভাবে চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়, ঠিক সেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয় ফিলিস্তিন ইস্যুতে। তারপরও বাংলাদেশকে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া—সব কটি বৃহৎ শক্তিকে পাশে নিয়েই রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিতে হবে।
নিরাপদ অঞ্চল না হওয়া অবধি পুনর্বাসন চলতে পারে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও শরণার্থী হাইকমিশনের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের কাজ করে আসছে। তবে সেটি খুব ক্ষুদ্র পরিসরে। আন্তর্জাতিক মহলে প্রধান উপদেষ্টার বিপুল গ্রহণযোগ্যতাকে পুঁজি করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের কাজকে বেগবান করা যেতে পারে। আর তা অন্য দেশগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
তবে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ ও পুনর্বাসন—এ দুটি ধারাবাহিকভাবে নয়, সমান্তরালভাবে চলতে হবে। সেই সঙ্গে এ–ও মনে রাখতে হবে যে পুনর্বাসন কখনো গণহত্যার জবাব হতে পারে না। সুতরাং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, লবিং ইত্যাদি অব্যাহত রাখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাম্বিয়া উদ্যোগটি শুরু করলেও বাংলাদেশের এখন আর নিষ্ক্রিয় থাকার সময় নেই।
রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল কেবল এই জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত, অনিরাপদ, আশাহীন জীবনের অবসান ঘটাবে। সেই সঙ্গে তা বাংলাদেশের নিজের জন্য এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও সবচেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
● ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
● ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাধারণ সম্পাদক, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, যুক্তরাষ্ট্র