ইয়েমেনে বিমান হামলার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে
ইয়েমেনে বিমান হামলার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে

মতামত

হুতিদের থামানো যে কারণে অসম্ভব

সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৬৮টি জাহাজ চলাচল করে। বিশ্বের মোট বাণিজ্যিক পণ্যের ১২ শতাংশ পরিবহন হয় এই পথ দিয়ে। সে কারণেই দুই মাস ধরে লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীরা বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে যে হামলা চালিয়ে আসছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে সেটা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ইয়েমেনে হুতি ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধারণাটিই সবচেয়ে প্রবল।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এই সামরিক পদক্ষেপের পেছনে কৌশলটা কী? এর মধ্য দিয়ে কি জাহাজে হামলা থামানো যাবে? এই কৌশল কি গাজা যুদ্ধ বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়া বন্ধে কোনো সহায়তা করতে পারবে?

প্রথমত, হুতিরা কী পছন্দ করে, তা নিয়ে কারোরই বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়।

ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত সরাসরি লড়াইয়ে হুতিদের দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা প্রমাণের জন্য এ সংখ্যা যথেষ্ট হতে পারে।

যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ ও চিকিৎসা না পাওয়ায় ২ লাখ ২৭ হাজারের বেশি ইয়েমেনি নিহত হয়েছেন। সেখানকার মানবিক সংকট এখনো চলমান। দারিদ্র্য পরিস্থিতি খুবই সঙিন। হুতিনিয়ন্ত্রিত এলাকায় সরকারি চাকরিজীবীদের সাত বছর ধরে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। হুতি শাসনে সাধারণ ইয়েমেনিরা কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়।

লোহিত সাগরে হুতিরা বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ করেছে। হুতিরা দাবি করেছে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে তারা এটা করছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই যে হুতিরা আরব বিশ্বে বৈধতা অর্জনের চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে জাহাজে হামলার মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের ভেতরে তাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বিমান হামলায় হুতির সামরিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। এখন যদি পশ্চিমা বাহিনী ‘ইটের বদলে পাটকেল ছুড়তে হবে’ এ রকম প্রতিশোধস্পৃহা থেকে ইয়েমেনে হুতিনিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিমান হামলা শুরু করলে যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হবে, তার পরিণাম কী হতে পারে?

এ ছাড়া হুতিদের এই কর্মকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার লড়াইয়ে হুতিদের প্রধান মিত্র ইরানের জন্যই সহায়ক হবে।

এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে ইয়েমেনে যে হামলা শুরু করল, তাতে হুতিদের এসব অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।

হুতির সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করার এবং লোহিত সাগরে হুতিরা যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে, সেগুলো ধ্বংস করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর রয়েছে। কিন্তু যে শক্তির বলে হুতি একের পর এক গোলা ছুড়ছে, সেই শক্তিকে কি নিশ্চিহ্ন করতে পারবে পশ্চিমারা?

সেটা যে পারবে না, তা এরই মধ্যে পরিষ্কার। হুতিরা এরই মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জঙ্গি বিমান তাদের ওপর হামলা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা লোহিত সাগরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে।

একটা বিষয় স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে দীর্ঘদিন ধরে চলা ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব হাজারোবার বিমান হামলা করেছে। এরপরও হুতিদের শক্তি খর্ব করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী অনেক সীমিত পরিসরে হামলা করছে। সেটা যে তেমন কার্যকর হবে না, সেটার প্রমাণ তো দেখা গেলই। হামলা চালানোর জন্য যে অস্ত্রশস্ত্র দরকার, সেটা হুতিরা যেকোনোভাবেই ইরানের কাছ থেকে পেয়ে যাবে।

সে কারণে সামরিক দিক বিবেচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এই বিমান হামলা তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে বাস্তবসম্মত পথ নয়। ইয়েমেনে বিমান হামলাকে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দ্বিচারিতা।

লোহিত জাহাজ চলাচলে বাধা তৈরি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যে সমর্থন দিয়ে চলেছে, তাতে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে চলেছে, তার কারণে গাজায় এবার এখন পর্যন্ত ২৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা এখন দাবি করছেন, হুতির বিরুদ্ধে তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ হচ্ছে তারা লোহিত সাগরে সওদাগরি জাহাজের বেসামরিক লোকদের সুরক্ষা দিতে চান। এটা তাদের উঁচুমাত্রার ভণ্ডামি। ফিলিস্তিনে তারা হাজার-হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যার অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে চলেছেন (যার বেশির ভাগ নারী ও শিশু)। তাদের মুখে বেসামরিক মানুষের রক্ষার বয়ান মানায় না।

মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটা বাস্তব। সেটা এখন আরও বাড়ছে। এতে হুতিরা আরব বিশ্বে বৈধতা পাওয়ার যে চেষ্টা করে চলেছে, তাতে সমর্থন বেড়ে চলেছে।

গাজায় আগ্রাসন, ইয়েমেনে হামলা, ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে চলমান সংঘাত, লেবাননে হামলা চালিয়ে হামাস অথবা হিজবুল্লাহের নেতাদের হত্যা—এ সবকিছু শুধু আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে না, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা শঙ্কা তৈরি করছে।

লোহিত সাগরে জাহাজ সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য নৌশক্তি দায়িত্বের অংশ। হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ঠেকানোর দায়িত্বও তাদের।

এটা সত্য যে আজ হোক কাল হোক হুতির ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ফাঁকি দেবে। আর তাতে সাধারণ মানুষের প্রাণ যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য যৌথভাবে যে বিমান হামলা শুরু করেছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে তারা কৌশলগত নীতি থেকে নয়, অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে, এই নীতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বিমান হামলায় হুতির সামরিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। এখন যদি পশ্চিমা বাহিনী ‘ইটের বদলে পাটকেল ছুড়তে হবে’ এ রকম প্রতিশোধস্পৃহা থেকে ইয়েমেনে হুতিনিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিমান হামলা শুরু করলে যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হবে, তার পরিণাম কী হতে পারে?

লোহিত সাগরে হুতির হামলা বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিমান হামলাকে হুতিরা দেশের ভেতরে তাদের অবস্থান পোক্ত করার কাজে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের বৈধতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেটাকে ব্যবহার করবে।

এর মানে হচ্ছে, উপসর্গ নয়, অসুখের কারণ নির্মূল করতে হবে।

সবার আগে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি সেখান থেকে তাদের সরে আসতে হবে।

  • রিচার্ড বার্ডেন ব্রিটেনের লেবার পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য, ব্রিটেন-ফিলিস্তিন সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপের ছায়া মন্ত্রী ও চেয়ার