চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল পার্ক
চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল পার্ক

মতামত

ডিসি হিল ‘মুক্ত’ হবে কবে

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের উদ্যম ও সামর্থ্যের প্রশংসা করতে হয় খোলামনেই। দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র বছর দেড়েক সময়ে তাঁর বেশ কিছু উদ্যোগ নগরবাসীর কাছে স্বস্তি ও আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।

প্রভাবশালীদের কবল থেকে সরকারি জমি ও সম্পদ উদ্ধারে যে সাহস ও উদ্যমের পরিচয় দিয়েছেন ফখরুজ্জামান, তার তুলনা এ অঞ্চলে বিরল। খেলার মাঠগুলোকে মেলার উত্পাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারেও তাঁর অনমনীয়তা সমর্থন পেয়েছে নাগরিক সমাজের।

২০২৩ সালে স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জ প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে অভিনব। এতে চট্টগ্রামের স্কুলশিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক সমাজ উপকৃত হয়েছে। এই সৃজনশীল পরিকল্পনা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

এখানে স্মার্ট স্কুলবাস প্রকল্পটি সম্পর্কে পাঠকদের কিছুটা ধারণা দেওয়া অপ্রসাঙ্গিক হবে না। এই দ্বিতল বাসের যাত্রী হিসেবে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করবে একটি স্মার্ট কার্ড। বাসে ওঠার সময় হাজিরা যন্ত্রের সামনে কার্ডটি রাখলেই খুদে বার্তা পৌঁছে যাবে অভিভাবকদের মুঠোফোনে। এ ছাড়া চাইলে ঘরে বসে বাস ও শিক্ষার্থীর অবস্থানও দেখতে পারবেন অভিভাবকেরা।

এই দুর্মূল্যের বাজারে এই বাসের যাত্রীদের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচ টাকা। কিছুটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন অন্তত ১০টি দোতলা স্কুলবাসের নিয়মিত যাতায়াত চাক্ষুষ করায় সৌভাগ্য চট্টগ্রামবাসীর হয়েছে। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শহরের মনোরম স্থানগুলোতে ভ্রমণের জন্য পর্যটক বাস নামের ছাদখোলা দুটি বাসও চালু করেছেন তিনি। অবশ্য এই প্রকল্প আদৌ জনপ্রিয় হয়েছে কি না, বুঝতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।

চট্টগ্রামের ডিসি মহোদয়ের সবচেয়ে প্রশংসিত ও আলোচিত উদ্যোগ ফৌজদারহাট এলাকায় ডিসি পার্ক নামের মনোরম একটি উদ্যান নির্মাণ। ১৯৪ একর সরকারি খাসজমি উদ্ধার করে এই পার্ক নির্মাণ করেছেন তিনি, একসময় যেটি ছিল স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তদের চারণক্ষেত্র, মাদকসেবীদের আস্তানা।

জায়গাটি উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, বরং ১২৭ প্রজাতির লক্ষাধিক ফুলের চারা রোপণ করে আক্ষরিক অর্থেই গড়ে তুলেছেন দৃষ্টি-মনোহর পুষ্পোদ্যান। ফেব্রুয়ারি মাসে এই পার্কে আয়োজন করা হয়েছিল ফুল উত্সব। ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা সেই উত্সবে ঘুড়ি খেলা, পুতুলনাচ, জাদু প্রদর্শনী ছাড়াও প্রদর্শিত হয়েছিল চট্টগ্রামের নবীন–প্রবীণ শিল্পীদের ২০০টি চিত্রকর্ম। প্রবেশমূল্য দিয়ে সেই উত্সবে শরিক হয়েছিলেন হাজারো দর্শক!

ডিসি হিল পার্কে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও অধিক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি, সাউন্ডবক্স ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ, সর্বোপরি এখানকার পাহাড়চূড়ায় জেলা প্রশাসকের বাসভবন থাকায় তাঁর নিরাপত্তা ও নিদ্রা বিঘ্নিত হওয়ার মতো কারণের কথা নানা সময়ে উঠে এসেছে। এসব সুরাহা করা তো কঠিন কিছু নয়।

জেলা প্রশাসকের কর্মকাণ্ডের অকৃপণ প্রশংসার পর কিছু অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন না করলে এই লেখাটি একপেশে হয়ে পড়বে।

প্রথমেই কথা ওঠে, নন্দনকানন এলাকার যে অনতিউচ্চ পাহাড়টিতে ডিসির বাংলো অবস্থিত, সেটি ডিসি হিল পার্ক নামে পরিচিত শতাধিক বছর ধরে। ফৌজদারহাটে নতুন একটি পার্ক নির্মাণ করে তিনি একই নামকরণ করলেন কেন? পার্কটির সৌন্দর্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি বাংলা নামের কি এতই আকাল?

ফৌজদারহাটের ডিসি পার্ক যখন পত্র-পুষ্পে পল্লবিত, তখন শহরের প্রাণকেন্দ্র নন্দনকানন এলাকার ডিসি হিল পার্কটি কেন অবহেলা ও উপেক্ষায় শ্রীহীন হয়ে পড়ছে? আগে নগরবাসী বসন্তের আগমনের বার্তা পেতো ডিসি হিল পার্কের পলাশগাছে রক্তবর্ণ ফুলের উচ্ছ্বাস দেখে। সেই গাছগুলো কখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অযত্নে মরে গেছে জানি না। আবার নতুন করে পুরোনো দৃশ্য ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া যায় না?

ডিসি হিল পার্কে একটি মুক্তমঞ্চ আছে। অর্থাৎ অন্তত দেড় যুগ আগে এই পার্ক সংস্কার করার সময়ই এখানে অনুষ্ঠানাদি করার একটি সুযোগ রাখা হয়েছিল। মুক্তমঞ্চের সামনে পাহাড়ের ঢালে অর্ধবৃত্তাকারে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা দেখেও নিশ্চিত হওয়া যায়, ডিসি হিল পার্কে অনুষ্ঠানাদি করার ব্যবস্থা রাখতে চেয়েছিল তখনকার প্রশাসন। কিন্তু সেই সুযোগটি কেন রহিত করা হলো, তার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

পয়লা বৈশাখ ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান এখানে করা যাবে না, এমন একটি সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য বর্তমান জেলা প্রশাসকের নয়, কিন্তু তিনিও তাঁর পূর্বতনদের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। এমনকি এবার বসন্ত উত্সব করতে চেয়েও অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি-সংগঠকেরা।

একসময় ডিসি হিল পার্কে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। জনসমাগমও হতো প্রচুর। কারণ, নগরের কেন্দ্রস্থলে এমন একটি মুক্তমঞ্চ সত্যিকার অর্থেই দুর্লভ। এখন সিআরবির এলাকায় আরও একটি মুক্তমঞ্চ হয়েছে বটে, সেটি তুলনামূলক জনবিরল এলাকা। অনেক বড় আয়োজন ছাড়া সেখানে দর্শক-শ্রোতার সাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

ডিসি হিল পার্কে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও অধিক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি, সাউন্ডবক্স ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ, সর্বোপরি এখানকার পাহাড়চূড়ায় জেলা প্রশাসকের বাসভবন থাকায় তাঁর নিরাপত্তা ও নিদ্রা বিঘ্নিত হওয়ার মতো কারণের কথা নানা সময়ে উঠে এসেছে। এসব সুরাহা করা তো কঠিন কিছু নয়।

ডিসি হিলে অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদানের জন্য একটি কমিটি করা যেতে পারে। কমিটি অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণের ব্যাপারে কঠোর হলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মনে রাখতে হবে, নগরবাসী নির্মল বিনোদন পেলে তার প্রভাব পড়ে সমাজের সর্বত্র।

জেলা প্রশাসকের বাসভবনের নিরাপত্তা বা নিদ্রা বিঘ্নিত হওয়ার প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে একটি প্রস্তাব দিতে চাই। ওই পাহাড়চূড়ার বাড়িটি ছেড়ে ডিসি সাহেব শহরের যেকোনো এলাকায় সুন্দর ও আধুনিক সুযোগসংবলিত একটি বাড়িতে উঠে এলে সব দিক রক্ষা হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়।

দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে সবার আগে। ফখরুজ্জামান সাহেব কি তা পারবেন? যদি পারেন চট্টগ্রামবাসীর কাছে কৃতজ্ঞভাজন হবেন তিনি। নইলে শ্রীহীন ডিসি হিল পার্কের সঙ্গে নবনির্মিত ‘ডিসি পার্কে’র তুলনা করে হয়তো নগরবাসী গভীর দীর্ঘশ্বাসে স্মরণ করবেন, অখিলবন্ধু ঘোষের গাওয়া, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই গানের বাণী, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়।’

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও সাহিত্যিক