মতামত

নতুন শিক্ষাক্রমে দুর্বলতা কোথায়?

জাতীয় শিক্ষাক্রমের ঘোষণা আসার পর এই নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সব সমালোচকদের একটি বড় অংশ শিক্ষাক্রমের ভেতরে ঢুকতে পারেনি কিংবা যে পেরেছে, সে আসল জায়গায় পয়েন্ট আউট করতে পারেনি।

ফলে শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় একধরনের ধূম্রজাল তৈরি হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাক্রম ঠিক কোন কোন বিষয়ে দুর্বল, সেই বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি বলে মনে করছি।

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জাতীয় শিক্ষাক্রমে বয়সভিত্তিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সুস্পষ্ট একটি ধারণা দেওয়া হয়, যাতে করে সহজে বোঝা যায় শিক্ষার স্তর।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার স্তর ৬:৩:৩:৪। অর্থাৎ ৬ বছর প্রাথমিকে, ৩ বছর নিম্ন মাধ্যমিকে, ৩ বছর মাধ্যমিকে আর ৪ বছর স্নাতকে। ১৬ বছরের শিক্ষাজীবন শুরু হবে ৪-৫ বছর বয়সে। অথচ আমাদের শিক্ষাক্রমে প্রাক্‌-প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে কে কোন বয়সে প্রবেশ করবে, তা উল্লেখ করাই হয়নি।

শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক ধরা হলেও একসময় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চমাধ্যমিক বলা হলেও এবারের শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় এই দুই শ্রেণিকে ঠিক কোন স্তরে ফেলা হবে, পুরো তুলে ধরা হয়নি।

এমনকি দায়সারাভাবে এই দুই শ্রেণিকে শিক্ষাক্রমে স্থান দেওয়া হয়েছে, যার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। পাঠ্যপুস্তক বা বিষয়গুলো কী থাকবে, তা বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে মোট ভরের তিন-চতুর্থাংশ বিশেষায়িত বিষয়সমূহের জন্য এবং এক-চতুর্থাংশ ভর আবশ্যিক বিষয়সমূহের জন্য বরাদ্দ থাকবে এবং এই বিষয়গুলোতে বিভিন্ন শিখনক্ষেত্রের যোগ্যতাসমূহের সমন্বয় থাকবে।

একসময় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চশিক্ষার কাতারে ফেলা হতো। সময়ের সঙ্গে তার পরিবর্তন এসেছে। আমাদেরও উচিত এই চিন্তাধারার পরিবর্তন আনা। আমি মনে করি, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও ৬:৩:৩:৪ অনুসরণ করা উচিত। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, নবম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন মাধ্যমিক আর দশম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত মাধ্যমিক।

প্রচলিত উচ্চমাধ্যমিকে বিষয়াদি পড়াশোনার সুযোগ মেলায় পড়া সীমানার চেয়ে সময় কম হয়ে যায়। দুই বছরের একাদশ-দ্বাদশ শেষ হয় দেড় বছরে। তাই অনেক পড়াশোনায় ফাঁক থেকে যায়। আমি মনে করি, প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে পাবলিক পরীক্ষা দশম শ্রেণিতে নেওয়ার পরিবর্তে দশম-একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পড়াশোনা শেষে পাবলিক পরীক্ষা থাকা উচিত। যার ফলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষার কাঠামো অনুসরণ করার সুযোগ পাবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা দেখলে মনে হয় অনেকটাই তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশন অনুসরণ করতে গিয়ে, সেই বিষয়টির আলোকপাতই করা হয় দুর্বোধ্যভাবে, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে পৌঁছাবে না। যেমন কম্পিটেন্সি–বেইজড এডুকেশনকে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বলা হচ্ছে, অথচ এটি হবে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে কতটা জানল, ক্লাসেই কতটা রেসপন্সড করল, তা বোঝাতে ‘যোগ্যতা’ শব্দটি বেমানান বটে।

শুধু তা-ই নয়, পুরো রূপরেখায় বেশ জটিল ভাষায় ভাষান্তর করে ফেলছে, যা পড়ে সহজেই কেউ বুঝতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। যেমন ভাষাভিত্তিক পাঠ্যক্রমে ঠিক কী থাকছে, তা বোঝাতে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম বলছে, বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য ছয়টি প্রয়োগের স্থান নির্ধারণ করেছে।

এইগুলোকে বলা হচ্ছে, ভাষিক যোগাযোগ, বাচনিক উৎকর্ষ, শিখন-শেখানো কার্যক্রম, প্রায়োগিক ও পেশাগত যোগাযোগ, মানবিক চিন্তন, সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রকাশ। অথচ এগুলোকে ইংরেজি ভাষা থেকে রূপান্তর না করে সহজভাবে বলা যেত, ভাষার মাধ্যমে কীভাবে যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান, পাঠদান কার্যক্রম, জীবন-জীবিকা কীভাবে মানবিক ও সৃষ্টিশীলতার মধ্যে অবদান রাখছে, তা সুন্দরভাবে তুলে ধরা যেত। শুধু এই বিষয়গুলো নয়, পুরো রূপরেখায় ধরনের ট্রান্সলেটরের প্রভাব লক্ষ করার মতো।

বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমানো হবে। অথচ আগের শিক্ষাক্রমের চেয়ে অনেকটাই বেশি পাঠ্যপুস্তক পেতে যাচ্ছে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে। প্রাথমিক ৮টি আর মাধ্যমিকে ১০টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এর আগের শিক্ষাক্রমে কম ছিল। সুতরাং কেউ যদি বলে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমিয়ে ফেলার লক্ষ্য নতুন শিক্ষাক্রম আসছে, তাহলে সেটি সঠিক হবে বলে মনে করি না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষার মৌলিক ভিত্তি কেবল পাঠ্যপুস্তকে নয়, বরং চারপাশের পরিবেশ, আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা রেখে নিজেকে মানবিক হতে হলে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার যে শিক্ষা, তা কেবল পরিবার নয়, বরং প্রাক্‌ ও প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত থাকা জরুরি।

এই যে ধরুন, জাপানের কথা। এই দেশটি আজ সভ্য, মানবিক ও পরিশ্রমী কেন? সেই দেশে বাচ্চাদের ফাউন্ডেশন তৈরি হয় নিজের ও অন্যের অধিকার আদায় করার জন্য। নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ক্লাস শেষে প্রতিদিনই তারা শ্রেণিকক্ষ যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, তেমনি দলবদ্ধভাবে সরকার থেকে সরবরাহকৃত মধ্যাহ্নভোজ করার সুযোগ পায়। ফলে ধনী-গরিবনির্বিশেষে খাবার থেকে সবাই একই পুষ্টি লাভ করে। আমাদের দেশে এমন সুযোগ আদৌও হবে কি না, সন্দেহ আছে।

ক্লাস শেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নর দায়িত্বে পড়লে অনেক সময় দেখা যাবে ধনী, প্রভাবশালীদের সন্তান করতে চাইবে না। কারণ, সে শিক্ষা সে পরিবার থেকে শেখার প্রয়োজন পড়েনি। এমন একটি ভগ্ন সমাজব্যবস্থা নিয়ে ঠিক আমরা কতটা সফল হব, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

প্রাক্‌-প্রাথমিক ব্যতীত প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমে শিল্প ও সংস্কৃতি জানানোর কথা বলা হচ্ছে। এই বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে দারুণ কাজ হলেও এটির বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।

এই দেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থাকায় বহুমতের ও ধর্মের মানুষের বিশ্বাসবোধের জায়গাও ভিন্ন। শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে, চারু ও কারুকলা, নৃত্য, সংগীত, যন্ত্রসংগীত, আবৃত্তি, অভিনয়, সাহিত্য ইত্যাদি চর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মননে যেমন নান্দনিকতার বিকাশ লাভ করবে, তেমনি শিক্ষাটাকে আনন্দঘন, উপলব্ধির সুযোগ মিলবে।

এ ছাড়া নিজ দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন এবং অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারবে। কিন্তু এমন একটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সমাজ থেকে যে আপত্তি আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে বিজ্ঞান পাঠ নিয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ বিজ্ঞান থাকলেও নবম-দশম শ্রেণি হতে বিষয়ায়িত বিজ্ঞান না থাকায় সমালোচনার ঝড়টা একটু বেশি চলছে।

একটা সময় মানুষ মনে করত, বিজ্ঞানশিক্ষা সবার প্রয়োজন নেই, জায়গা থেকে দেরিতে হলেও সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তাকে স্বাগত। কারণ, পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে আপনাকে বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো জানতেই হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় সবার জন্য অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি করা মূলত বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলানোর কৌশল বটে। তবে এই শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানবিষয়ক যে ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা খুবই অস্পষ্ট ও বাস্তবমুখী নয়।

শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে, বিজ্ঞানের ভৌতবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং পৃথিবী ও মহাকাশবিজ্ঞান-এই তিনটি বিশেষায়িত ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। যেখানে রসায়নের মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত। প্রাণী ও উদ্ভিদের সমন্বয়ে যদি জীববিজ্ঞান আলোচিত হয়, সেই ক্ষেত্রে সমস্যা নেই, তবে সবার জন্য বিজ্ঞান বই তৈরি করতে গিয়ে আমাদের বাচ্চারা অন্যান্য দেশের বাচ্চাদের চেয়ে পিছিয়ে গেলেই সমস্যা প্রকটতর হয়ে উঠবে।

ভৌতবিজ্ঞানে কেবল বস্তু কণার গঠন আচরণ, মিথস্ক্রিয়া নিয়ে আলোচনার কথা বললেও জীববিজ্ঞানে কেবল সজীব উপাদানের গঠন আচরণ, মিথস্ক্রিয়া আর আর্থ সায়েন্স পৃথিবী থেকে শুরু করে সমগ্র মহাবিশ্বের গঠন এবং প্রকৃতি সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণের কথা বলা হচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে এই বিজ্ঞান পাঠ কখনোই সুখকর হয়ে উঠবে না।

জাপানের একটি শিশু যদি অষ্টম শ্রেণির মধ্যেই ভৌতবিজ্ঞানে বিদ্যুৎ চলাচল ও তার ব্যবহার, গতি ও শক্তি, রাসায়নিক অণু ও পরমাণুর পরিবর্তন নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্ঞান অর্জন করে, আলো ও শব্দ, লেন্সবিষয়ক পাঠোদ্ধার করে, তাপ, চাপ আর গ্যাসীয় বস্তু নিয়ে বিস্তারিত পড়ার সুযোগ পায়, সেখানে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে কেবল বস্তু কণার গঠন আচরণ, মিথস্ক্রিয়া, স্থিতি নিয়ে আলোচনা বড়ই বেমানান।

কেবল সজিব উপাদানের গঠন নিয়ে আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়, বিজ্ঞানকে পূর্ণভাবে জানতে উদ্ভিদ, প্রাণীর দেহবিষয়ক বিস্তারিত জানাও জরুরি। কোষের বিভাজন, প্রজনন, জিনের নিয়ন্ত্রণ, রোগবালাই বিষয়ের জ্ঞান যেমন প্রয়োজন তেমনি রসায়নের মৌলিক ধাপ সম্মুখ আলোচনা দরকার।

সব মিলিয়ে বিজ্ঞানকে পোক্ত করার জন্য আরও বেশি আলোচনার প্রয়োজন, যা নতুন শিক্ষাক্রমে উপেক্ষিত হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে ‘কৃষি শিক্ষা’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষিকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। জীবন ও জীবিকাবিষয়ক অধ্যয়নের সুযোগ থাকলেও কৃষিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

বলা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের শ্রমবাজার নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সঠিকভাবে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং মাধ্যমে কর্মজগতে প্রবেশের জন্য রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা (ট্রান্সফারেবল স্কিল) ও বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) দক্ষতা অর্জনের সুযোগ মিলবে। এটিও একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। তবে জীবিকার সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই কথা বলা বাহুল্য। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তিকে অতিরিক্তভাবে বিষয় না করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যেত।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশের কোন খেলার মাঠ নেই। যেগুলো আছে, সেগুলো আবার বিভিন্ন সময়ে সাপ্তাহিক হাটবাজার বা অন্যান্য দখলে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা থেকে থাকছে বঞ্চিত।

‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয় যখন জাতীয় শিক্ষাক্রমে স্থান পেয়েছে, তখন মাঠ ছাড়া খেলাধুলার ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক। মানসিক ও শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব পাঠ্যপুস্তকে গণ্ডিবদ্ধ থাকলে এর সুফল আমরা পাব না। বরং স্কুলগুলোতে শরীরচর্চার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা না তৈরি করে ‘শিক্ষাক্রমে’ স্বাস্থ্য সুরক্ষা ঢুকিয়ে পড়া বড্ড বেমানান। এটি অনেকটাই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের শামিল।

বাণিজ্যবিষয়ক জ্ঞানের সুযোগ প্রস্তাবিত রূপরেখা দেখতে পাইনি। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে তৈরি করতে বাণিজ্যবিষয়ক পাঠ আবশ্যিক হয়ে উঠেছে, সেই বিষয়টি আমাদের শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন।

জাতীয় শিক্ষাক্রমে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে, সেটিকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন দক্ষ ও বিচক্ষণ শিক্ষক সমাজ, যারা একজন শিক্ষার্থীর নিরপেক্ষভাবে জ্ঞান, দক্ষতার মূল্যায়ন করবে। খোদ শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে, এটি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ, পেশাদার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। নতুন শিক্ষাক্রমের আগে অতীতে আমাদের দেশে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা সচল ছিল।

পত্রপত্রিকায় হামেশাই খবর বের হতো, ১০ বছর পরও এই পদ্ধতিটি দেশের সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কাছেই বোধগম্য ছিল না। এমন একটি জনগোষ্ঠীর কাঁধে দেশের যে শিক্ষাব্যবস্থা উঠতে যাচ্ছে, তা আরও বেশি জটিল ও কণ্টকময়।

শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষকদের বৈষম্য যেমন পরিলক্ষিত, তেমনি শিক্ষার আনুষঙ্গিক কাঠামোতে থাকে ভিন্নতা। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে স্বজনপ্রীতি বা সুবিধাভোগী। শ্রেণিশিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের ফলাফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ফেলে। এমন মানসিকতার শিক্ষকদের কাঁধে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সুযোগ ঠিক কতটা নিরপেক্ষ থাকবে তা বলা কঠিন। এমন এক পরিস্থিতিতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক কতটা প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষকদের সামনে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা হাজির করছে, তা জানা জরুরি।

বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী পেশাদার শিক্ষক নিয়োগ করে এ পরিবর্তন করার কথা বললেও বাস্তবতায় ঠিক কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তা ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে শিক্ষকদের কাঁধে মূল্যায়নের মতো জটিল বিষয়গুলোর সমাধান আগে না হলে এমন শিক্ষাক্রমের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে, মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের শিক্ষার রথ। এখন সরকারই নিজেকে প্রশ্ন করুক যে তারা যে শিক্ষাক্রম করতে যাচ্ছে, তাতে শিক্ষক সমাজ ঠিক কতটা গলাধঃকরণ করতে পেরেছে।

ইউনেসকোর সহায়তায় আরও কয়েকটি দেশ জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এনেছে। তবে সেগুলো উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে এখনো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

পারদর্শিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আমরা এখনো প্রস্তুত হয়ে উঠিনি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেই সুযোগ-সুবিধা পায়নি, শিক্ষকেরাও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সুযোগ পাননি, এমন অবস্থায় তড়িঘড়ি করে ‘যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম’ চালু করা উচিত হবে বলে মনে করি না। বরং আরও সময় নিয়ে, শিক্ষাক্রমের সংস্কার বা সংশোধন এনে শিক্ষার্থীদের কাছে বোধগম্য পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে এই পথে পা বাড়ানো উচিত। সেটি না করতে পারলে ভালো একটি উদ্যোগ আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার মতোই ব্যর্থ শিক্ষাক্রমে পরিণত হতে পারে। তাই সরকারের উচিত, আরও সময় নেওয়া, নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবতার নিরিখে পাঠ্যক্রম তৈরি করা। দেশ-বিদেশের বিষয়ভিত্তিক স্পেশালিস্ট, গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

বিশ্বাস করি, সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বাতিল না করে আপাতত স্থগিত করুক। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ না বানিয়ে উপযুক্ত বিশ্বমানব তৈরির প্রকৃত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com